খিচুড়ি রান্নার পদ্ধতি শিক্ষা, পুকুর কাটার প্রশিক্ষণ নেয়ার মতো উদ্ভট সব প্রকল্পের বরাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ঘটনায় দেশজুড়ে হইচই হয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের তাতে হুঁশ হয়নি। একই পথে হাঁটছেন তারা। এবার একটি নদী ভাঙন প্রতিরোধ প্রকল্পে বিদেশে সফরের প্রস্তাব করেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগ। প্রাথমিক পর্যায়ে পরিকল্পনা কমিশন এ প্রস্তাবে ত্রুটি দেখতে পেয়েছে। সমাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে প্রহসন, আলোচনা ও সমালোচনা।
জানা গেছে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওই প্রকল্প প্রস্তাবনায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণের নামে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। প্রাথমিক পর্যায়ে বাধা দেয় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কমিশনের কর্তাদের সংশ্লিষ্টরা বুঝাতে সক্ষম হন যে, বিদেশ যাওয়া আবশ্যক। সেই মোতাবেক দেড় কোটি টাকা কমিয়ে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করা হচ্ছে।
তবে বিদেশ সফরের সু্যোগ থাকলেও পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে প্রকল্পটির বিভিন্ন ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বেশ কিছু ব্যয় কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘হবিগঞ্জ জেলার বিবিয়ানা-৩, বিবিয়ানা-দক্ষিণ ও সামিট বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামনে অবস্থিত কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরে ভাঙন রোধ’ প্রকল্পে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। আগামী ২২ নভেম্বর ২০২০, রোববার প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এতে সভাপতিত্ব করবেন কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য মো. জাকির হোসেন।
জানায় যায়, ‘কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরে ভাঙন রোধ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১৮ কোটি টাকা। প্রক্রিয়াকরণ শেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ২ জুলাই প্রকল্পটি নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাবদ ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার সংস্থান রাখার প্রস্তাব করা হয়।
তবে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বা স্টাডি ট্যুরের সংস্থান বাদ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তীকালে আলাপ-আলোচনার পর দেড় কোটি টাকা কমিয়ে ২ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়ে আলোচনা হয়। যার সাপেক্ষে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বা স্টাডি ট্যুর বাবদ ২ কোটি টাকার সংস্থান রাখা যেতে পারে বলে পিইসি সভায় সুপারিশ করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে শর্ত দিয়ে বলা হয়েছে, কোন্ মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানের কতজন, কি বিষয়ে, কত ব্যাচ ও কোন দেশ ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে ডিপিপিতে উল্লেখ করা যেতে পারে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরে ভাঙন রোধ’ প্রকল্পের আওতায় অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয় বাবদ ১০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। সেটি কমিয়ে ৫ লাখ টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ৫০ কিলোমিটার বৃক্ষরোপণের জন্য দেড় কোটি টাকা প্রস্তাব থেকে কমিয়ে ২০ লাখ টাকা, গ্যাস ও জ্বালানি বাবদ ৫ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ৩ লাখ টাকা, পেট্রল-অয়েল-লুব্রিকেন্ট বাবদ ৫ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ৩ লাখ টাকা, বিভিন্ন কমিটির সম্মানী বাবদ ১০ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ৮ লাখ টাকা, মুদ্রণ ও বাঁধাইবাবদ তিন লাখ টাকা থেকে কমিয়ে দুই লাখ টাকা এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা মেরামত বাবদ ৩০ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া মোটরযান মেরামত বাবদ ৫ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে দুই লাখ টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের মতামতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদীতীর সংরক্ষণ বাবদ মোট ২৫২ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ( প্রতি মিটার ৩ দশমিক ৪১ লাখ টাকা) সংস্থান রাখা হয়েছে। নদীর তীর প্রতিরক্ষা বাবদ ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পিইসি সভায় ব্যাখ্যা করতে পারে। তাছাড়া নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজের চেইনেজ, নকশা, স্থান এবং এ কাজে ব্যবহৃত ম্যাটারিয়ালের বিস্তারিত বিবরণ ডিপিপিতে উল্লেখসহ এ খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ২ দশমিক ৬ কিলোমিটার ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ বাবদ ১ কোটি ২৮ লাখ টাকার (প্রতি মিটার ৫ হাজার টাকা) সংস্থান রাখা হয়েছে। তবে ওয়ার্কওয়ে নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
অন্যদিকে যেসব প্রকল্পে বিদেশ সফরের প্রয়োজন নেই, সেসব প্রকল্পে বিদেশ সফরের বরাদ্দ না রাখতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পরিকল্পনা বিভাগের মাসিক সমন্বয় সভায়। প্রকল্পের বিদেশ সফর বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশ সফরের বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে দেখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) আসবে সেগুলো ভালো করে পর্যালোচনা করতে হবে। অস্বাভাবিক কিছু থাকলে তাৎক্ষণিক তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠাতে হবে। যেসব প্রকল্পে বিদেশ সফরের প্রয়োজন নেই, সেসব প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব বাদ দিতে হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম প্রধান (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মন্টু কুমার বিশ্বাস জানান, অনেক প্রকল্পে বিদেশি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সব প্রকল্পেই বিদেশি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। পিইসি সভায় আলোচনার পর বিয়য়টি চূড়ান্ত করা হবে। গত বুধবারও একটি প্রকল্পের পিইসি সভায় বিদেশ সফরের বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে।
মিই/আরা/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ