একদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের মত ঘটনা। প্রায় প্রতিমাসেই কয়েক স্থানেই অগ্নিকাণ্ডের মত ঘটনা ঘটে। তবুও দক্ষ হয়ে ওঠেনি আমাদের দমকল বাহিনী। গতকাল সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড বেভারেজ কোম্পানির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিন্তু সারা রাতেও তা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারেনি। দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় আগুন নিভলে শুক্রবার (৯ জুলাই) দুপুর সোয়া একটার পর কারখানার অভ্যন্তর থেকে ৫০ জনের লাশ বের করতে থাকেন উদ্ধারকর্মীরা।
এদিকে কারখানায় আগুনের ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। এর মধ্যে ৩৩ জনের নাম-পরিচয় পেয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। নিখোঁজদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি। তবে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির এডমিন ইনচার্জ সালাউদ্দিন মিয়া জানান, অগ্নিকাণ্ডের সময় সেকশনের পাঁচটি ফ্লোরে প্রায় চারশ’ শ্রমিক ওভারটাইম করছিলেন।
এরআগে, আগুনে তিন জনের নিহতের তথ্য জানানো হয়। এরা হলেন— স্বপ্না রানী (৪৪) ও মিনা আক্তার (৪৩) মোরসালিন (২৪)। নিহত স্বপ্না হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার গুলডুবা এলাকার যতীন সরকারের স্ত্রী ও নিহত মীনা কিশোরগঞ্জের কমিরগঞ্জ উপজেলার উত্তরকান্দা কুকিমাদল গ্রামের হারুনের স্ত্রী। তারা উভয়ই কারখানার ওডি সেকশনের শ্রমিক বলে নিশ্চিত বরেন সেখানকার অপারেটর আজিজ মিয়া।
এছাড়া আগুনে আহত হয়েছেন আরও প্রায় অর্ধশত শ্রমিক। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সংঘর্ষ
এদিকে আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাসেম ফুড লিমিটেডের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে সংরক্ষণাগার থেকে তিনটি শটগান লুট করে নিয়ে যায়।
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আনসার ক্যাম্পে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।
আনসারদের প্রশিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ নাছিমা বেগম বলেন, হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কম্পানির সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাশেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা ক্যাম্পের অস্ত্র সংরক্ষণাগারের তালা ভেঙে তিনটি শটগান লুট করে নেয়। এ হামলায় কাউসার, বিশ্বজিত, ফারুক, মোশরাকুলসহ প্রায় পাঁচ আনসার সদস্য আহত হন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও আঞ্চলিক পুলিশ ও রূপগঞ্জ থানা পুলিশ উপস্থিত হয়।
অস্ত্র লুটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান নাছিমা বেগম।
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের পুলিশ টিয়ারশেল ও কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাশেম ফুডস লিমিটেডের ছয়তলা ভবনের নিচ তলার একটি ফ্লোরে বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় গোটা কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। এ সময় ঘটনাস্থলেই স্বপ্না রানী ও মিনা আক্তার নামে দুই নারী শ্রমিক নিহত হন। পরে রাত ১১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মোরসালিন (২৮) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়।
আগুনে কারখানার কাঁচামাল, উৎপাদিত পণ্য, মূল্যবান সামগ্রীসহ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খবর পেয়ে কাঞ্চন, পূর্বাচল, ডেমরা, আড়াইহাজার, আদমজী ফায়ার সার্ভিসের ১১ ইউনিটের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণ কাজে যোগ দেন। রাতে ১১টি ইউনিটের সঙ্গে আরও ৭ ইউনিট যোগ দিয়ে মোট ১৮ ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। আগুনে ভবনের বিভিন্ন তলায় কারখানার কর্মচারী ও কর্মকর্তারা আটকা পড়েন। কেউ কেউ লাফিয়ে পড়ে আহত হন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষিত দমকল বাহিনীর অভাবে প্রতিটা অগ্নিকাণ্ডকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় আমাদের দমকল বাহিনী। রুপগঞ্জের মত বাণিজ্যিক এলাকায় যখন এমন ব্যর্থতার চিত্র, তখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোর চিত্র স্বাভাবিকভাবে অনুমানযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও আগুন নেভানোর যন্ত্র উন্নয়ন ও দমকল বাহিনীর দক্ষতা উন্নয়নে তেমন কোনো জোর নেই। ফলে প্রতিটা অগ্নিকাণ্ড শেষে আমাদের দেখতে হয় লাশের স্তুপ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৫
আপনার মতামত জানানঃ