উচ্চহারে টিকাদানের মাধ্যমে ধনী দেশগুলো নিজেদের আখের গুছিয়ে ভাবছেন মহামারি করোনা ফুরিয়ে গেছে। গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের এ কথা বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস।
তিনি বলেছেন, কিছু দেশ উচ্চহারে টিকাদানের মাধ্যমে স্বস্তিতে রয়েছে। কিন্তু তারা এমন ভাব করছে যেন মহামারি ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু অতি-সংক্রামক ভ্যারিয়েন্ট ও ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির ‘মর্মান্তিক বৈষম্যের’ কারণে অন্যান্য দেশে সংক্রমণ তীব্র হয়েছে।
সাংবাদিকদের জানান, সংক্রমণের ক্ষেত্রে, বিশ্ব এখন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে, কারণ বিশ্বময় অসমান টিকা কর্মসূচির কারণে দ্রুত সংক্রমণশীল ভেরিয়েন্ট এতটা ছড়িয়ে পড়েছেI
তিনি জানান, বহু দেশ, যেখানে টিকা দেয়ার হার বেশি, তারা আগামী মাসগুলিতে বুস্টার ডোজ কর্মসূচি গুটিতে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছেন, দূরত্ব বজায় রাখার সরকারি বাধানিষেধ বাদ দিয়েছেন এবং এমনিভাবে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে দিয়েছেন যে, মহামারীর যেন অবসান হয়েছেI
বলেন, দুঃখজনক অসমান টিকা কর্মসূচি এবং দ্রুত বর্ধনশীল ভেরিয়েন্টের কারণে পৃথিবীর প্রত্যেকটি অঞ্চলের বহু দেশে আজ সংক্রমণ ও হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে I
তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে ভেরিয়েন্ট জয়ী হচ্ছে, যার কারণ ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বিতরণে অসমতা, যা বিশ্বের অর্থনীতির জন্য এখন এক বিশেষ হুমকির কারণI
একদিকে যখন অনেক ধনী দেশ করোনাভাইরাস মহামারির বিধি-নিষেধ শিথিল করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এই মহামারির সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, এই মহামারির বিপজ্জনক এক সময়ে রয়েছে বিশ্ব।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, মহামারির এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে প্রাণহানির সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে বুধবার।
জাতিসংঘের স্বাস্থ্যবিষয়ক এই সংস্থা বলছে, বর্তমানে করোনা মহামারির বৈশ্বিক ‘হটস্পটে’ পরিণত হয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির হাসপাতালগুলো করোনা রোগীদের ফেরত পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। বুধবারও দেশটিতে রেকর্ড ১ হাজার ৪০ জনের প্রাণ কেড়েছে করোনা।
মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় হাসপাতালে রোগীর চাপ, অক্সিজেনের সঙ্কটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ইন্দোনেশিয়া। লকডাউন জারি করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনভাবেই সংক্রমণ কমার কোনও লক্ষণ নেই। সংক্রমণ এবং মৃত্যু পাল্লা দিয়ে বাড়ছেই।
অক্সিজেনের সঙ্কট কমাতে পার্শ্ববর্তী সিঙ্গাপুর থেকে আকাশপথে আনা হচ্ছে অক্সিজেন। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ায় বাইরে তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও চিকিৎসকরা হিমসিম খাচ্ছেন।
এদিকে একদিনে দেশটিতে রেকর্ড ৭২৮ জন মারা গেছেন করোনায়। আক্রান্ত ও মৃতের দিক দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শীর্ষে এখন এই দেশটি। এরপরেই রয়েছে ফিলিপাইন।
ইন্দোনেশিয়ায় এখন পর্যন্ত ৩৪টি প্রদেশের সবটাতে করোনার বিস্তার ঘটেছে। এতে নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয়েছেন ২২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৪ জন মানুষ। মারা গেছেন কমপক্ষে ৬০ হাজার ৫৮২ জন। সম্প্রতি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সেখানে পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলেছে।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশজুড়ে লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২০ জুলাই পর্যন্ত লকডাউন জারি থাকবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
দেশটিতে বর্তমানে প্রতিদিন ২৫ হাজারের বেশি নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে। গত কয়েক মাসে সেখানে কোভিড কেস শনাক্ত হয়েছে কয়েক লাখ।
মূলত ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের ভিড় বেড়ে যাওয়া এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণেই সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।
এই মহামারিতে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ কোটি ৫৫ লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষ। বৈশ্বিক হিসেবে করোনায় সর্বাধিক ৬ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। একই সঙ্গে দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ কোটি ৪৬ লাখ ২২ হাজারের বেশি। এছাড়া লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের হিসেবে তৃতীয় স্থানে থাকলেও মৃত্যুর সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস প্রাণ কেড়েছে ৫ লাখ ২৭ হাজারের বেশি এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৮৮ লাখ ৫৫ হাজার ১৫ জন।
টিকাযুদ্ধে তহবিলের অর্ধেকই ঘাটতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বৈশ্বিক পর্যায়ে করোনার টিকা, চিকিৎসা, শনাক্ত ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য তহবিল জোগানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু সংস্থাটির এখনো প্রয়োজনীয় তহবিলের অর্ধেকই ঘাটতিতে। তাদের এখনো ১৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। গত মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য বাড়ার মধ্যেই তহবিল সংকটের এ তথ্য জানানো হলো।
টেড্রোস মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, যেসব দেশ এখন তাদের দেশে বিধিনিষেধ শিথিল করছে, তারা ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম, পরীক্ষা, অক্সিজেন এবং বিশেষত টিকার মতো জীবনরক্ষার সরঞ্জামকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।
টেড্রোস আরও বলেন, যেসব দেশে জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামের যথেষ্ট সরবরাহ নেই, তারা হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর ঢেউয়ের মুখোমুখি হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অ্যাকসেস টু কোভিড টুলস অ্যাকসেলেরেটর (এসিটি-এ) কর্মসূচির মাধ্যমে ১৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল এ বছরের মধ্যে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এ কর্মসূচির মাধ্যমে আরও প্রায় ১৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থ জরুরি ভিত্তিতেই প্রয়োজন।
এসিটি-এ কর্মসূচির মাধ্যমেই কোভ্যাক্স নামের উদ্যোগটির সৃষ্টি হয়, যার মাধ্যমে দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এএফপির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এখন পর্যন্ত ২১৬টি দেশ ও অঞ্চলে ৩২৫ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে প্রতি ১০০ জনে ৮৪ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের ২৯টি দেশে প্রতি ১০০ জনে মাত্র ১ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।
কোভ্যাক্স মঙ্গলবার জানিয়েছে, বিশ্বের ১৩৫টি অঞ্চলে ১০ কোটি টিকা দেওয়ার মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এ পর্যায়ে তা ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডোজ হওয়ার কথা ছিল বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী সোম্য স্বামীনাথান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ