ফেনসিডিলের পর ইয়াবা দেশের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক মাদক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছিল। তবে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের ‘আত্মহত্যা’র কারণ তদন্তে নেমে এলএসডি নামের ভয়ানক মাদক উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এলএসডির পর ডিএমটি নামের আরেক ভয়ানক মাদক উদ্ধার করা হয়। এমডিএমএ হলো— ৩, ৪ মেথাইলিন ডাইঅক্সি মেথা এমফিটামিন। কোকেন সেবনের মতো এটি শরীরে প্রভাব ফেলে। এমডিএমএর পর এবার ৬ হাজার বছর পুরনো মাদক ‘ম্যাজিক মাশরুম’ নতুন করে আলোচনায় এল।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে র্যাব-১০-এর একটি দল রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘ম্যাজিক মাশরুম’ নামের মাদক উদ্ধার করেছে। এর সঙ্গে জড়িত অভিযোগে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
উদ্ধার হওয়া মাদকের পরিমাণ ও গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় প্রাথমিকভাবে জানায়নি র্যাব।
র্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক ইমরান হোসেন আজ বুধবার সকালে গণমাধ্যমকে বলেন, এ নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন হবে। আজ বেলা একটার দিকে অনুষ্ঠেয় এই সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে।
কী এই ‘ম্যাজিক মাশরুম’?
জানা গেছে, সাইলোসাইবিন মাশরুম, এক ধরনের অপ্রচলিত ছত্রাক। তবে ভ্রম বা মায়া উৎপাদনকারী ভেষজ হিসেবে এর ব্যবহার প্রায় ছয় হাজার বছরের পুরনো। এখন বিশ্বের মাদক সাম্রাজ্যে এর পরিচিতি ‘ম্যাজিক মাশরুম’ বা ‘জাদুকরী ছত্রাক’ হিসেবে। প্রাচীনকালে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও চিকিৎসায় কাজে লাগানো হলেও এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়ংকর মাদকের একটি।
ব্যাঙ্গের ছাতা বা মাশরুম আমরা সবাই চিনি। এর মাঝে কিছু মাশরুম রয়েছে যেগুলো খাবার হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। আবার কিছু মাশরুম আছে যেগুলো ভয়াবহ রকমের বিষাক্ত। তাই সব ধরণের মাশরুমই খাওয়া যায় এ ধারণা ভুল। আবার এক রকমের মাশরুম আছে যাদেরকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মাদকদ্রব্য। এটি ম্যাজিক মাশরুম নামে সাধারণভাবে পরিচিত।
এই মাশরুমে থাকে সাইকোএক্টিভ ইন্ডোল এলকালয়েড নামের রাসায়নিক পদার্থ। তাই কেউ যদি এই মাশরুম খেয়ে ফেলে তখন এই রাসায়নিক পদার্থ তার মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এর ফলে মানুষের আচরণ, মনোভাব, চিন্তাকরা ও মনে রাখার ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়ে যেতে থাকে। অনেক সময় এটি মানুষের চেতনাশক্তিকে সাময়িকভাবে লোপ করে দিতে পারে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে এই মাশরুমের বিচিত্র ব্যবহারে কথা আমরা জানতে পারি। উত্তর আফ্রিকায় Tassili n’Ajjer এলাকাতে প্রাপ্ত বেশ কিছু প্রাচীন পাথরের উপর খোদাই করা চিত্রে এই মাশরুমের ছবি দেখা যায়।
গ্রন্থকার জিওর্জিও স্যামোরিনির মতে, খুব সম্ভবত সেই যুগে সাইলোসাইবিন মাশরুমকে মানুষ ব্যবহার করতো সাময়িক চেতনানাশক হিসেবে। তারা এই মাশরুম সেবন করে মৃত আত্মাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতো।
গ্রন্থকার জিওর্জিও স্যামোরিনির মতে, খুব সম্ভবত সেই যুগে সাইলোসাইবিন মাশরুমকে মানুষ ব্যবহার করতো সাময়িক চেতনানাশক হিসেবে। তারা এই মাশরুম সেবন করে মৃত আত্মাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতো।
কেউ এই মাশরুম খেয়ে ফেললে সে সাময়িকভাবে অচেতন হয়ে পড়ে। এর আগে তার মাঝে নানা ধরণের আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। সাইলোসাইবিন-এর এই চেতনাশক্তি হ্রাসকারী প্রভাব তিন থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এটি নির্ভর করে কী পরিমাণ মাশরুম খাওয়া হলো তার উপর। মাশরুম খেয়ে ফেলার আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মাঝে মানুষের দর্শন ও শ্রবণ শক্তিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চলে আসে। মানুষ চোখে বিচিত্র রঙ দেখতে থাকে যেগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব নেই। আবার বাস্তব জগতের অনেক রঙ তাদের কাছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল মনে হয়। অনেকে আবার এই মাশরুম থেকে পাওয়া সাইলোসাইবিনকে কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক উভয়ভাবে উৎপাদন করে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবছেন। যেমন obsessive-compulsive disorders ।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ ও জন হপকিন্স স্কুল অব মেডিসিন পরিচালিত এক গবেষণাতে দেখা যায়, নিয়মিত সাইলোসাইবিন মাশরুম সেবন করলে তা বিষণ্ণতা-প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে। তবুও সাইলোসাইবিন মাশরুমের মাঝে থাকা psilocybin ও psilocin দুটিই রাসায়নিক পদার্থই জাতিসংঘে ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত Convention on Psychotropic Substances এর ‘শিডিউল-১ ড্রাগ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এই তালিকার ড্রাগগুলোকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর ও চিকিৎসাকাজে ব্যবহারে অনুপযোগী হিসেবে ধরা হয়।
অনেক দেশেই এই মাশরুম কেনা-বেচা বা বহন করা নিষিদ্ধ। আমেরিকাতে Psychotropic Substances Act, ইংল্যান্ডে Misuse of Drugs Act 1971 and Drugs Act 2005, এবং কানাডাতে Controlled Drugs and Substances Act এর মাধ্যমে এই মাশরুমের ব্যবহার হয় নিষিদ্ধ, না হয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
নেদারল্যান্ড ডিসেম্বর ১, ২০০৮ থেকে তাদের দেশে সাইলোসাইবিন মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে অনেক দেশে এটি এখনো নিষিদ্ধ নয়। যেমন অস্ট্রিয়াতে এটিকে মাদক বলে গণ্য করা হয় না।
বাংলাদেশেও নেশা হিসেবে এর ব্যবহার হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কাদের হাত ধরে দেশে ঢুকল অপ্রচলিত এই মাদক তা নিয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে একাধিক সংস্থা। ইউরোপ-আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই পরিচিত এই মাদক দেশের শিক্ষিত ও বিত্তবান পরিবারের বখে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের কাছে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে ম্যাজিক মাশরুম কেনাবেচা বা খাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে এই প্রথম আটক করা হলো। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে, বাংলাদেশি তরুণদের মধ্যে এই মাদকের প্রচলন আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ