প্রকল্প দৌঁড়ায় কচ্ছপের গতিতে। কিন্তু সরকারের ঋণ নেয়ার গতি খরগোশের। এদিকে, সন্তানকে খাওয়াতে না পেরে আত্মহত্যা করে সাধারণ দিনমজুর। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থ কর্মকর্তাদের ভুঁড়ির আকার বাড়তে থাকে দ্রব্যমূল্যের মতো। আর সরকার জানে, টাকা দেবে গৌরী সেন। ঋণ শোধরানোর আদৌ কোনো পরিকল্পনা তাদের আছে কিনা, এই নিয়ে সন্দেহ অমুলক না। প্রতিবছর বাড়ছে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ। বাড়ছে প্রকল্প ব্যয়। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না সুফল। এমনই এক প্রকল্প পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দেশের বৃহত্তম এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতিমাসে লোকসান ১১৫ কোটা টাকা। কর্মকর্তাদের অদক্ষতা আর অলসতার ভুঁড়ি ঢাকতে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে অন্য এক প্রকল্পকে। এভাবে এক প্রকল্পের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অন্য আরেক প্রকল্প নিশানা স্থির করছে। ট্রিগারে আঙুল রেখে মাদার অব হিউম্যানিটি পাখির মতো গুলি করছে সাধারণ মানুষকে।
প্রতি মাসে লোকসান ১১৫ কোটি টাকা
যখন একের পর এক প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের নির্মাণকাজ শেষ করতে না পেরে বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের অজুহাতে পরিণত হচ্ছে, সেখানে সময়ের আগেই নির্মাণকাজ শেষ করে বাহবা কুড়িয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা। তবে খুশি হবার কারণ অতোটুকুই। বর্তমানে এই কেন্দ্রের জন্যই বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিমাসে জরিমানা গুণছে ১১৫ কোটি টাকা।
সঞ্চালন লাইন নির্ধারিত সময়ে শেষ না করেই, মাসে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার এই ঘটনার বিচার দাবি করছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার না হওয়ায় তেলনির্ভর বেশি দামের বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করতেই হচ্ছে সরকারকে। আবার ক্যাপাসিটি চার্জে লোকসানও গুণতে হচ্ছে।
দেশের বৃহত্তম এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে। চীন-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই কেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসে গত বছরের ১৫ মে। ওই বছরে ৮ ডিসেম্বর শেষ হয় একই সক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটির। কিন্তু তারপরই থেকেই বসে আছে কেন্দ্রটি।
নতুন একটি সঞ্চালন লাইন দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ঢাকায় সরবরাহের কথা থাকলেও তার নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি এখনো। ফলে, কেন্দ্র বসিয়ে রাখায় ছয় মাস ধরে ১১৫ কোটি টাকা করে ক্যাপাসিটি শোধ করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
এ ঘটনায় ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের অভিযোগ, পায়রার এই জরিমানা এড়ানো যেতো। ইচ্ছা করেই গ্রাহকদের টাকা লোপাট হচ্ছে অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এদিকে, নির্ধারিত সময়ে এই কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান পিজিসিবি বলছে, পদ্মাসেতু কর্তৃপক্ষের কারণেই কাজ শেষ হচ্ছে না।
কী বলছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা?
এ প্রসঙ্গে, পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী (পূর্ত) মো. রেজওয়ান ইকবাল খান জানান, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে এখান থেকে উৎপাদিত ৬২২ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে দক্ষিণবঙ্গের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এর আগে গোপালগঞ্জ থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত ১৬০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করে চালু করা হয়। কিন্তু গোপালগঞ্জের গ্রিড থেকে ঢাকার আমিন বাজার পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ওই লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
তিনি জানান, পদ্মায় রিভার ক্লোসিং লাইন নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। সেটি কমপ্লিট হলেই খুব দ্রুত সময়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। কিন্তু আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যদি গোপালগঞ্জ টু ঢাকার আমিন বাজারের সঞ্চালন লাইন চালু না হয় সেক্ষেত্রে সরকারকে লোকসান গুনতে হতে পারে বলে আশংকা করছে কর্তৃপক্ষ।
তবে একটি ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ আর ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত লোন (কিস্তি) পরিশোধ করতে কোন সমস্যা নাই বলেও জানান রেজওয়ান ইকবাল খান।
তিনি আরও জানান, বেইজলোড পাওয়ার প্লান্ট হওয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ না করতে পারলেও অর্থাৎ প্লান্ট বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি প্রেমেন্ট দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সেই হিসাবে একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ বাণিজ্যকভাবে সরবরাহ করে এবং ক্যাপাসিটি প্রেমেন্ট এই দুই মিলে বিদেশি লোনের কিস্তি শোধ করা সম্ভব।
পিজিসিবি বলছে, পদ্মাসেতু কর্তৃপক্ষ ৭টি টাওয়ার বুঝিয়ে না দেয়ার কারণেই আটকে আছে সঞ্চালন লাইনের কাজ। তবে, সঞ্চালন লাইন নির্ধারিত সময়ে শেষ না করেই, মাসে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার এই ঘটনার বিচার দাবি করছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার না হওয়ায় তেলনির্ভর বেশি দামের বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করতেই হচ্ছে সরকারকে। আবার ক্যাপাসিটি চার্জে লোকসানও গুণতে হচ্ছে।
সূত্র মতে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মধ্যে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করার চুক্তি ছিলো। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯০ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ।
মাথাপিছু ঋণ ২৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা
বেড়েই চলছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা। দেশের প্রতিটি মানুষের ঘাড়ে এই মুহূর্তে (গত জুন পর্যন্ত) ২৩ হাজার ৪২৫ টাকা ৫২ পয়সা করে বৈদশিক ঋণ রয়েছে। আজ যে শিশু জন্মগ্রহণ করবে, ওর মাথায়ও এই ঋণের বোঝা চাপবে। এদিকে দিনে দিনে কমছে সহজ শর্তের বা স্বল্পসুদের ঋণ। ইতোমধ্যে ঋণের সুদ ও শর্ত বাড়িয়েছে উন্নয়নসহযোগীরা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের অর্থ সঠিক এবং প্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যয় করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, চড়া সুদসহ বিভিন্ন কঠিন শর্তে ঋণ নিয়েও প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে সরকার। কিন্তু সেই টাকার যদি কার্যকর ব্যবহার না হয় কিংবা রিটার্ন ঠিকমতো না আসে, তাহলে সাধারণ মানুষের ঘামের টাকায় পরিশোধ করা এই ঋণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে পারে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ‘ফ্লো অব এক্সটার্নাল রিসোর্স ইন টু বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে (গত জুন পর্যন্ত) বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি রয়েছে ৪ হাজার ৪০৯ কোটি ৫১ লাখ মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে) দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮৯৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরে হিসাব করলে প্রত্যেকের মাথায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৩ হাজার ৮৪৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলার এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৩ হাজার ৩৫১ কোটি ১৮ লাখ ডলার।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ