হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডের পর দেশে ‘মানবিক বিয়ে’ নামে নতুন এক শব্দযুগলের আবির্ভাব ঘটে, যেটা প্রচলিত ইংরেজি শব্দে ‘লিভ ইন’ কিংবা ‘লিভ টুগেদার’ হিসাবেও বিবেচিত হয়। মামুনুল হকের পর হেফাজতের আরও কয়েক নেতার বিরুদ্ধেও এই মানবিক বিয়ের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া যায়। এবার দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইসলাম ধর্মের তীর্থভূমি সৌদি আরবেও এই মানবিক বিয়ের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। খবর এএফপির।
সৌদিআরবে ক্রমেই চুক্তি ভিত্তিক নামমাত্র বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে। শর্তহীন এই বিয়ে সৌদি সমাজে ‘মিসইয়ার’ নামে পরিচিত। তবে এই বিয়ে নিয়ে চিন্তিত সৌদির ‘ধর্মীয়’ ব্যক্তিরা। তাদের অভিযোগ ‘মিসইয়ার’-এর মাধ্যমে আদতে উচ্ছৃঙ্খলতাকেই বৈধতা দান করা হচ্ছে।
জানা যায়, মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী বিয়ের আগে সহবাস অবৈধ। তবে এই মিসইয়ারের আড়ালে সৌদি ব্যক্তিরা ‘লিভ-ইন’ বা পরকীয়ায় মেতেছেন। এর জন্যে বিশেষ ‘ম্যাচ-মেকিং’ সাইট বা গ্রুপও আছে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
মিসইয়ার বিয়ে কী বা কেমন?
সৌদিআরবে বন্ধনহীন চুক্তি-বিয়ে (মিসইয়ার) বাড়ছে। ‘জাওয়াজ আল মিসইয়ার’ নামে পরিচিত এ বিয়েকে ‘ভ্রমণকারীদের বিয়ে’ও বলা হয়।
স্থানীয় সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে এ বিয়ে প্রচলিত রয়েছে। কোনোরকম আত্মিক বন্ধন ছাড়া এ বিয়ের চুক্তি অনুযায়ী তারা একসঙ্গে থাকতে পারবে।
এর শর্ত অনুযায়ী স্ত্রীর আবাস সংস্থান ও অর্থ ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকবেন স্বামী। বিনিময়ে গৃহ রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার ঘরে ঢোকার অনুমতি পাবেন স্বামী। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিয়ের বৈধতা দেওয়ার জন্য কয়েকটি মুসলিম দেশে চাপ বাড়ছে।
মিসইয়ার বিয়ের শর্তের মধ্যে আরও রয়েছে উভয়ের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে নগদ অর্থ। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে এর মেয়াদ। তবে যেকোনো সময়ে উভয়পক্ষ মুসলিম বিয়ের মূল রীতি অনুযায়ী বিয়ে করতে পারবেন। আবার যেকোনো সময় একে অন্যকে ছেড়ে যেতে পারবেন। লোকলজ্জার ভয়ে সাধারণত এ বিয়ের কথা গোপন রাখা হয়।
জানা যায়, মিসইয়ার প্রকৃতপক্ষে বৈবাহিক সম্পর্ক ও একাকী জীবনের একটা মিশ্রণ। যেখানে বহুগামী নারী-পুরুষ দ্বিতীয় সংসার বয়ে বেড়ানোর চাপ এড়িয়ে বৈবাহিক সম্পর্কের সুবিধা উপভোগ করে থাকেন।
২০১৪ সালে প্রথম আরব নিউজ এ বিয়ের বাস্তবতা নিয়ে প্রতিবেদন রচনা করেছিল। কয়েক দশক ধরে স্থানীয়ভাবে আইনসিদ্ধ এ বিয়ের প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে যাওয়ায় সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সমালোচনার জবাবও দিয়েছেন কয়েকটি মিসইয়ার যুগল। লজ্জা ও সমালোচনা এড়াতে তাদের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এএফপিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তারা।
সাক্ষাৎকারে তাদের ভাষ্য অনুযায়ী বহুবিবাহে আগ্রহীদের জন্যই মিসইয়ার ব্যবস্থা বিশেষভাবে উপযোগী। ধনী ব্যক্তিদের জন্য দ্বিতীয় তার চেয়ে বেশি বিয়ে করার সুযোগ দেয় এ ব্যবস্থা।
এটি আগ্রহী নারীদের পুরুষতান্ত্রিক নানা জটিলতা থেকে দূরে রাখে। এ বিয়েকে হালাল বলে দাবি করেন সৌদির ৪০ বছর বয়সী এক সরকারি কর্মকর্তা।
ওই ব্যবস্থা সম্পর্কে সৌদি সরকারি কর্মীর দাবি, ‘মিসইয়ার বৈধ পন্থায় আরাম, স্বাধীনতা ও সাহচর্যের মাধ্যম।’ তিরিশোর্ধ্ব বয়সী এক নারীর সঙ্গে দুই বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এমন সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে এই ব্যক্তি বলেন, প্রচলিত পন্থায় তিনি একটি বিয়ে করেছেন। সেই ঘরে তিনটি সন্তান। রিয়াদের বাড়িতে তার এক মিসইয়ার স্ত্রী রয়েছেন। তার কাছে যখন ইচ্ছা তিনি যান। এই গোপন সংসার থেকে কোনো অর্জন বা প্রাপ্তি আছে কি না, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে তিনি বলেন, তার এক বন্ধুর এক ডজনের মতো মিসইয়ার স্ত্রী রয়েছে। তিনি একজনকে তালাক দেন, অন্যজনকে বিয়ে করেন। একজনকে তালাক দেন, অন্যজনকে বিয়ে করেন…।
ঝুঁকছেন প্রবাসীরাও
স্থানীয় নাগরিকদের মতো সৌদি আরবে বসবাসকারী প্রবাসী কর্মীরাও এ ধরনের বিয়েতে ঝুঁকছেন বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। নিজেদের পার্টনার খুঁজতে অনলাইনে বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপ ও বিয়ের ঘটকালিতে নিয়োজিত ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হচ্ছেন তারা।
রিয়াদে কর্মরত মিসরের একজন ফার্মাসিস্ট (৪০) এএফপিকে বলেন, ‘মিসইয়ার সস্তা। এ বিয়েতে অর্থের দেনাপাওনা নেই, নেই কোনো দায়বদ্ধতাও।’
মিসরের এই কর্মী আরও বলেন, গত বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে তিনি স্ত্রী ও পাঁচ বছর বয়সী সন্তানকে দেশে পাঠিয়ে দেন। পরে মিসইয়ার স্ত্রীর খোঁজ শুরু করেন। ইনস্টাগ্রামে এক ঘটকালি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৫ হাজার রিয়াল (১ হাজার ৩৩৩ ডলার) ফি দাবি করে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আমার ওজন, উচ্চতা, গায়ের রং…জানাই। তবে এখনো মিসইয়ার স্ত্রীর সন্ধান পাইনি।’
রিয়াদে বসবাস করা এক সিরিয়ান মহিলার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু জানিয়েছেন, ওই মহিলা তার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর গোপনে মিসইয়ার বিয়ে করেছেন। তার ধারণা, তার সৌদি প্রাক্তন স্বামী এ বিয়ের কথা জানতে পারলে তার দুই সন্তানকে ফেরত চাইতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতামত
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন বিয়েতে নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকি আছে। তারপরও কিছু নারীর কাছে এই পদ্ধতি পুরুষতান্ত্রিক প্রচলিত বিবাহব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা উপায়। আবার অবিবাহিত দম্পতিরা একে নিজেদের যৌন চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে একধরনের বৈধতার আবরণ হিসেবে বিবেচনা করেন। যদিও ইসলামে বিবাহবহির্ভূত যেকোনো শারীরিক সম্পর্কই নিষিদ্ধ।
২০১৮ সালে প্রকাশিত আল ওয়াতান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন জানিয়েছে, এ ধরনের বিয়েগুলো স্বল্পস্থায়ী হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলোর স্থায়িত্ব হয় ১৪ থেকে ৬০ দিন।
তারা বলেছেন, এ বিয়ে বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা মহিলাদের জন্য খুবই উপযোগী।
রিয়াদের একজন আলেম বলেন, যারা বিয়ের পর স্ত্রী-সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে রাখতে চান না, তারাই এ ধরনের বিয়েতে বেশি উৎসাহী। এ ধরনের পুরুষদের কারণেই এ বিয়ের বিস্তার ঘটেছে।’
২০১২ সালে সৌদি গেজেটে প্রকাশিত একটি কলামে লেখক তারিক আল-মায়না মিসইয়ারকে অনেক বেশি দায় ছাড়াই একাধিক সঙ্গীর লাইসেন্স বলে মন্তব্য করেছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ