আফগানস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে একের পর এক জেলা দখল করে নিচ্ছে তালিবান। এতে হতাশা বেড়েছে আশরাফ ঘানি সরকারের মধ্যে। গত ২৪ ঘণ্টায় তালিবান আফগানিস্তানের আরও ১৩টি জেলা নিজেদের দখলে নিয়েছে। এনিয়ে দেশটির ৩৭২টি জেলার মধ্যে তালিবানের দখলে এলো ১১০টি জেলা।
আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক তালিবানের উৎপাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আপাতত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে আফগানিস্তানে তালিবানের প্রতি তাদের সমর্থন রয়েছে।
নিজেদের পুরাতন দুর্গ হিসেবে পরিচিত এবং আফগানিস্তানের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র কান্দাহার পুনরায় দখলে নিয়েছে তালিবান। আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমগুলোর সূত্র মতে, গতকাল শনিবার রাতে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের মাধ্যমে শহরটি দখলে নেয় তালিবান।
ঝুঁকিতে সাধারণ মানুষ
জেলাগুলো পুনরুদ্ধারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তালিবানদের তীব্র লড়াই চলছে। এতে আতঙ্ক বাড়ছে সাধারণ জনগণের মাঝে। এরই মধ্যে দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নিহত হয়েছে বহু সাধারণ মানুষ। তারা চাচ্ছে যে কোনো একপক্ষের বিজয়ের মাধ্যমে এই লড়াইয়ের অবসান হোক।
এদিকে আজ রবিবার (৪ জুলাই) বিকেলে কান্দাহার গভর্নরের পার্কিং চত্বরে বিস্ফোরণে দুই জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন গভর্নরের সেক্রেটারি এবং অন্যজন নিরাপত্তা প্রহরী। এছাড়া আহত হয়েছে আরও এক নিরাপত্তা প্রহরী।
এর আগে শনিবার ৩ জুলাই আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ বাদাখশানে নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ২০ তালিবান সদস্য নিহত হয়েছে। এছাড়া প্রদেশটিতে গত দুই দিনের সংঘাতে অন্তত তিনজন নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছেন।
গত ১ জুলাই রাতে আফগানিস্তানের বাদাখশান ও উত্তরাঞ্চলীয় বাঘলান প্রদেশে তালিবানের হামলায় অন্তত ২৩ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল সাধারণ মানুষ। তবে কয়েকজন নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য ও তালিবানা যোদ্ধাও ছিল নিহতের তালিকায়।
পুরুষদেরও লম্বা দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক এবং নারীরা বাড়ি থেকে পুরুষ অভিভাবক ছাড়া একা বের হতে পারবেন না। এমন আইন জারি করেছে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে তাকহার প্রদেশে দখলদার তালেবান গোষ্টি।
পুরুষদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক, নারীরা একা বেরুতে পারবে না
পুরুষদেরও লম্বা দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক এবং নারীরা বাড়ি থেকে পুরুষ অভিভাবক ছাড়া একা বের হতে পারবেন না। এমন আইন জারি করেছে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে তাকহার প্রদেশে দখলদার তালেবান গোষ্টি। এমনকি নারীদের বিয়ের জন্য পণ প্রথাও ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। আফগানিস্তান আবার যেন অন্ধকার যুগে প্রবেশ করছে।
এক বিজ্ঞপ্তিতে তালেবান এসব নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বলে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে তাকহার প্রদেশের সমাজকর্মী মেরাজউদ্দিন স্থানীয় এক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এই চর্চা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তবে তালেবান নেতরা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে এ ধরনের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে।
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা মোতায়েন হওয়ার আগে তালেবান সরকার কর্তৃক এসব আইন জারি ছিল। তখন দেশটিতে নারীদের চাকরি তো দূরের কথা, কোনো পুরুষ আত্মীয় ছাড়া বাইরে বের হওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তালেবান প্রবর্তিত নিয়মগুলো না মানলে তখন কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হত। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘সভ্যতার পেছন দিকে হাটছে আফগানিস্তান’ বলে মন্তব্য করেছেন।
শক্তি বাড়াচ্ছে তালিবানরা
এদিকে আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার হচ্ছে অন্যদিকে নিজেদের পেশিশক্তি বাড়াচ্ছে তালিবান। ২ জুলাই প্রায় দুই দশক পর আফগানিস্তানে নিজেদের প্রধান সামরিক ঘাঁটি থেকে বিদায় নিল যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনারা। তারা বাগরাম বিমান ঘাঁটি খালি করে দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এক মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর সব সদস্য বাগরাম বিমান ঘাঁটি ছেড়ে গেছে।
কাবুল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই ঘাঁটি থেকেই আফগানিস্তানে সকল বিমান হামলা ও কৌশলগত কার্যক্রম পরিচালনা করতো মার্কিন সামরিক বাহিনী। ঘাঁটিটি এবার আফগান সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন থেকে যার নেতৃত্ব দেবে আফগান বাহিনী।
প্রাণ হারিয়েছেন ৪০ হাজারের বেশি মানুষ
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারসহ তালিবানের আরও দুটি হামলায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এই হামলার জন্য আল কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হয়।
এরপর থেকে আফগানিস্তানে হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১১ সাল থেকে চলা যুদ্ধ-সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৬৪ হাজারের বেশি আফগান সেনা ও পুলিশ নিহত হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন ৪০ হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ। এছাড়া আরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিদেশি সেনা নিহত হয়েছেন।
এ অবস্থায় সম্প্রতি আফগানিস্তান যুদ্ধে ইতি টানার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি জানিয়েছেন, ৯/১১ হামলার দুই দশকপূর্তির আগেই আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ওজেএ/৪৮১৫
আপনার মতামত জানানঃ