কওমি জননীর কওমি মাদ্রাসা নিয়ে বর্তমান অস্বস্তি সন্দেহের চোখে দেখছেন অনেকেই। সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে নিয়মের মধ্যে আনার জন্য কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তাদের বেসরকারি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থাকার পরও সরকারের এই উদ্যোগ নিয়ে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িতদের অনেকের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সরকার আসলে কী করতে চাইছে এই নিয়েই চিন্তায় আছেন মাদ্রাসার নেতৃত্ব।
‘যত্রতত্র হেফজোখানা নামে সাইনবোর্ড তুলে দিচ্ছে’
প্রসঙ্গত, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগারি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেই কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তারা যেমন রয়েছেন, একইসাথে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার বেসরকারি বোর্ডের নেতাদেরও রাখা হয়েছে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে বা খতিয়ে দেখে যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, এবার সেগুলো সমাধানের একটা চেষ্টা তারা করবেন।
গঠিত এই কমিটি তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মাদ্রাসা নেতৃত্বকেও চিঠি দিয়ে জানিয়েছে ইতিমধ্যে। শিক্ষা উপমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসাগুলোর কিছু প্রতিষ্ঠান এতিমখানা হিসাবে পরিচালিত হয়, আবার কিছু কিছু জায়গায় লিল্লাহ বোর্ডিং নামে পরিচালিত হয়। কিছু কিছু মাদ্রাসা হাইআতুল উলয়া বোর্ডের অধীনে তাদের সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায় হাদিস প্রদান করে। আবার কিছু জায়গায় নূরানী মাদ্রাসা বা হেফজোখানা রয়েছে। এগুলোর নানান ধরনের ধাপ আছে।’
তিনি বলেন, ‘সেই ধাপগুলো কী প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হচ্ছে, এবং সেগুলোর অর্থায়ন কীভাবে হচ্ছে বা কারা সেগুলোতে পড়াচ্ছে এবং কারা সেখানে পড়ছে, সেই তথ্য সরকারের কাছে থাকা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিনই এরা কোন অনুমোদন ছাড়া যত্রতত্র হেফজোখানা নামে সাইনবোর্ড তুলে দিচ্ছে। এই জিনিসগুলো আমরা মোটামুটি খতিয়ে দেখেছি। এখন আমরা কমিটির মাধ্যমে এটা একটা ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনবো, নিয়মনীতির মধ্যে আনবো।’
সরকার নিজেই নিজের সাংঘর্ষিক?
কওমি মাদ্রাসাকে সরকারিভাবে নিবন্ধনের কোন ব্যবস্থা বাংলাদেশে নাই। মাদ্রাসার শিক্ষকরা নিজেরা শিক্ষাবোর্ড গঠন করে সিলেবাস এবং পরীক্ষার বিষয়গুলো পরিচালনা করেন। কিন্তু তাদের আবার একক কোন বোর্ড নেই। বেফাকসহ তাদের ছয়টি বোর্ডের অধীনে মাদ্রাসাগুলো বিভক্ত।
তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যখন কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ দাওরায় হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স এর মর্যাদা দিয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে মাদ্রাসার ছয়টি বেসরকারি বোর্ডের নেতৃত্বকে সমন্বয় করে সর্বোচ্চ একটি বোর্ড গঠন করে দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
সেই সর্বোচ্চ বোর্ডের সদস্য এবং হেফাজতে ইসলামের নেতা নুরুল ইসলাম জেহাদি বলেছেন, তাদের বোর্ডকে সরকার আগে যে দায়িত্ব দিয়েছে, তার সাথে সরকারের এখনকার উদ্যোগ সাংঘর্ষিক।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিছেন। এবং এখানে আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ নামের সর্বোচ্চ বোর্ড করা হয়েছে। এটা ছয়টা বোর্ড নিয়ে করা হইছে। এটার ব্যাপারে সরকারি গেজেট আছে। সেই গেজেটে সর্বোচ্চ বোর্ডকেই নিবন্ধনের দায়িত্ব দেয়া হইছে। এই বোর্ডই সিলেবাস ঠিক করবে।’
তিনি বলেন, ‘এই স্বকীয়তা বা স্বাধীনতা দেয়া হয়। এর সাথে দেওবন্দের সিলেবাস যে রকম, সেভাবেই কওমি মাদ্রাসা চলবে। এখন যে চিঠিটা আসছে, সেই বিষয়ের সাথে এটা সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে।’
নেতৃত্বহীন সময়ে পরিবর্তন সন্দেহজনক
কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে ঘিরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক হয়েছে। সর্বশেষ গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময় সংগঠনটির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা হয়। সে প্রেক্ষাপটে হেফাজতের অনেক নেতা জেলে গেছেন এবং সংগঠনটি চাপের মুখে রয়েছে।
ইসলাম বিষয়ক লেখক এবং গবেষক শরীফ মুহাম্মদ বলেছেন, মাদ্রাসার নেতৃত্ব যখন চাপের মুখে, তখন সরকার এমন উদ্যোগ নেয়ায় তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে একটা হচ্ছে নিবন্ধন এবং একটা তালিকার মধ্যে আনা। আরেকটা হচ্ছে এর সিলেবাস বা পাঠ্যতালিকা এবং সমন্বয় করা। এমন কিছু কমন বিষয় রাখা, যেটা নাগরিক হিসাবেও মানুষের দরকার। সরকারের দাবি বা বক্তব্য এরকম।’
শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘কিন্তু যখন করোনার জন্য মাদ্রাসা বন্ধ এবং কওমি মাদ্রাসার একটা প্যারালাল সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দের একটা বড় অংশ জেলে রয়েছে। এছাড়া মাদ্রাসাগুলোর দায়িত্বশীলদের ওপর একটা বড় চাপ বজায় রয়েছে। এরকম সময়ে এ ধরনের একটা পদক্ষেপ কওমি মাদ্রাসা অঙ্গনে ব্যাপক একটা সন্দেহ, সংশয় এবং অনাস্থার সৃষ্টি করেছে। আমি যতটা লক্ষ্য করেছি।’
নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করেই পদক্ষেপ নেবে সরকার
সরকার মনে করছে, দীর্ঘদিনের সমস্যা থেকে একটা নিয়মের মধ্যে আনার ক্ষেত্রে বিরোধিতা থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, কর্মমুখী শিক্ষা না হলে, সেটা সমাজের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ফলে সরকার এবার এই উদ্যোগ নিয়ে এগুবে।
তিনি বলেন, যারা সেখানে পড়ছেন, তারা সবাই কিন্তু আলেম হতে পারছেন না। তারা কর্মদক্ষ হচ্ছেন কিনা সেটা একটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। এগুলো পুরোপুরি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল, সেজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধান সেখানে ছিল না। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সবাই আলেম হতে পারেন না বা সম্ভব নয়, যেহেতু এত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নেই। সেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন মাদ্রাসা থেকে গিয়ে আরেকটি মাদ্রাসা খুলছে।
আরও বলেন, আমরা দেখছি গার্মেন্টস ঘন এলাকাগুলোতে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়ছে। সেখানে লিল্লাহ বোর্ডিং করে গামেন্টস এ যারা চাকরি করছেন, তাদের সন্তানদের সেগুলোতে ভর্তি করা হচ্ছে। যারা গার্মেন্টস নারীর এই ক্ষমতায়নে বিরোধিতা করছে, তাদের লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে বা মাদ্রাসায় তাদের সন্তানদের নারীর চাকরির বিরুদ্ধে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের বৈপরীত্যগুলোতো আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তিনি অবশ্য বলেছেন, মাদ্রাসার নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করেই সরকার পদক্ষেপ নেবে। তারা মনে করেন, এবার তারা ইতিবাচক সাড়া পাবেন।
এদিকে মাদ্রাসা বোর্ডের নেতারা বলেছেন, সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে তাদের এখনও সন্দেহ আছে। তবে তারা নিজেরা বিস্তারিত আলোচনা করে সরকারকে চূড়ান্ত অবস্থান জানাবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ