করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। বিশ্বের অনেক দেশ ভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনার ডেল্টা ধরনের কারণে ফের বাড়ছে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা, বাড়ছে আতঙ্কও। এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অনুমোদন পাওয়া টিকাগুলো ডেল্টা ধরনকে প্রতিরোধে কতোটা সক্ষম, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
তবে জনসন অ্যান্ড জনসনের দাবি, করোনার ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধেও কার্যকর তাদের করোনা টিকা। একইসাথে টিকাগ্রহণের পর আট মাস পর্যন্ত এর কার্যকারিতা থাকে বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জনসন অ্যান্ড জনসন সাম্প্রতিক দুটি গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানায়, মূল ভাইরাসের ধরনটির বিরুদ্ধে তাদের টিকা যতটা কার্যকর, তার চেয়ে ডেল্টা ধরনটির বিরুদ্ধে সামান্য কম কার্যকর। তবে সাউথ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া বেটা ধরনের চেয়ে ভারতে শনাক্ত ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে এ টিকা বেশি কার্যকর বলে জানিয়েছে উৎপাদক কোম্পানি।
গত আট মাসের তথ্য সামনে এনে সংস্থাটি দাবি করেছে, তাদের ভ্যাকসিন করোনা প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। আর এই ভ্যাকসিন নিলে করোনা মারাত্মক হবে না বা হাসপাতালে ভর্তিরও খুব একটা দরকার হবে না।
এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, গত আট মাসের বিশ্লেষণ বলছে— জনসন অ্যান্ড জনসনের কোভিড-১৯ টিকার একটি ডোজ নিলেই গ্রহীতার শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। যত দিন যাবে, এই অ্যান্টিবডি তত শক্তিশালী হবে। তাদের গত আট মাসের অভিজ্ঞতা এটাই বলছে।
গবেষকদের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, জেঅ্যান্ডজের টিকা নেয়ার পর শরীরে যে অ্যান্টিবডি গঠিত হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা শক্তিশালী হতে থাকে।
এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জেঅ্যান্ডজে জানিয়েছে, এ বিষয়ে করা দুটি গবেষণাপত্রই অনলাইনে প্রকাশের জন্য বৃহস্পতিবার জমা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি গবেষণাপত্র একটি বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকীতে প্রকাশের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। উভয় গবেষণাই ছোট পরিসরে, এবং গবেষকেরা বলছেন, জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে তারা গবেষণার ফলাফল দ্রুত প্রকাশ করেছেন।
বস্টনে বেথ ইসরায়েল ডিয়াকোনেস মেডিকেল সেন্টারের অনুজীব বিজ্ঞানী ড. ড্যান বারোচ বলেন, “করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরনের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা মানুষ যতোটা আশা করছে তার চেয়ে আরও ভালো হবে। অনেক বেশি বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তাই আমরা এই গবেষণার ফল সরাসরি জনসম্মুখে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনটির ঝুঁকি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ রয়েছে, বিশেষ করে যারা এরইমধ্যে টিকা নিয়েছেন তাদের অনেকেরই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তারা ঝুঁকিমুক্ত কিনা।
যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ জেঅ্যান্ডজের টিকা নিয়েছে। সেদেশের জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত যতগুলো কোভিড-১৯ এর টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সবগুলোই করোনাভাইরাসের বিদ্যমান সবগুলো ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে এতোদিন পর্যন্ত শুধু ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার টিকার তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতেই এই বক্তব্য দেওয়া হচ্ছিল। এরসঙ্গে এখন জেঅ্যান্ডজের টিকাও যুক্ত হল।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে নতুন করে যারা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন, তাদের প্রতি চারজনের একজনের দেহে ডেল্টা ধরনের উপস্থিতি মিলেছে।
ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের একজন রোগপ্রতিরোধবিদ ড্যানি অল্টমান বলেন, এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে সবগুলো টিকাই এখন পর্যন্ত জনসাধারণকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং মর্গ থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, অন্তত বিজ্ঞানীরা প্রথমে যতটা আশা করেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো ফলাফল এটা।
প্রসঙ্গত, ভারতে প্রথম সন্ধান পাওয়া পর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ইতিমধ্যেই গোটা ব্রিটেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ডেল্টার সংক্রমনের জেরে ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ শহরেই লকডাউন জারি হয়েছে। আমেরিকাতেও ক্রমশ বাড়ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সারা বিশ্বে এই ভ্যারিয়েন্ট দাপিয়ে বেড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে যাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি
ল্যানসেট প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী যাদের কোনো রকম কোমর্বিডিটি রয়েছে, বা যাদের বয়স বেশি, তাদের ডেল্টা সংক্রমণের ঝুঁকিও বাকিদের তুলনায় বেশি। ‘পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড’ জানিয়েছে, যে কম বয়সীদের টিকাকরণ হয়নি, তাদেরও যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে।
এই গবেষণায় স্কটল্যান্ডের ১৯,৫৪৩ জন সংক্রমিত এবং ৩৭৭ হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীদের নেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ৭৭২৩ রোগীই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমিত। ১৩৪ জনকে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়েছিল একই কারণে।
যাদের দুইটি টিকাই নেয়া হয়ে গেছে, তাদের ডেল্টা সংক্রমণের ঝুঁকি কম বলে জানায় এই গবেষণা।
‘পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড’এর অনুযায়ী ফাইজার এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি প্রতিষেধক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অনেকটাই কার্যকর। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত আটকাতে সক্ষম। তবে টিকাকরণ হয়ে গেলেও যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেল্টা সংক্রমণ হওয়া সম্ভব, তা জানিয়েছে এই গবেষণা।
‘ডেল্টা’ হবে করোনার প্রধান ধরন: ডব্লিউএইচও
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে বলেছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে করোনার প্রধান ধরন হবে ‘ডেল্টা’। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে করোনার ‘ডেল্টা’ ধরনের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এটি করোনার একটি অতি সংক্রামক ধরন।
গতকাল বৃহস্পতিবার এনডিটিভি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
করোনা মহামারি মোকাবিলায় যেসব হাতিয়ার এখন পর্যন্ত বিশ্বে বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলোই ডেলটার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। তবে বিশ্বে ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ বাড়ছে, তাই সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত রাখার দরকার পড়তে পারে বলে মনে করছে ডব্লিউএইচও।
গত ২৯ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ডব্লিউএইচও বলেছে, বিশ্বের ৯৬টি দেশ করোনার ডেল্টা ধরন শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে। তার মধ্যে কিছু দেশে করোনার ডেল্টা ধরন থেকে সংক্রমণ বৃদ্ধি ও সংক্রমিত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তির হার বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
ডব্লিউএইচও সতর্ক করে বলেছে, ডেল্টার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এই ধরনটি করোনার অন্য সব ধরনকে দ্রুত ছাপিয়ে যেতে পারে। আর এভাবেই আগামী মাস কয়েকের মধ্যে ডেল্টা করোনার প্রধান ধরন হয়ে উঠতে পারে।
৩০ জুন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন অংশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়ছে। করোনার সংক্রমণ নতুন করে বৃদ্ধির জন্য অতি সংক্রামক ডেল্টাসহ অন্যান্য ধরন ভূমিকা রাখছে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, দুঃস্বপ্ন ফিরে আসছে।
ডব্লিউএইচওর প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস গত সপ্তাহে বলেছিলেন, এখন পর্যন্ত শনাক্ত করোনার ধরনগুলোর মধ্যে ডেল্টা সবচেয়ে সংক্রামক। যারা টিকা নেয়নি এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেল্টা ধরন দ্রুত ছড়াচ্ছে।
গেব্রেয়াসুস বলেছিলেন, ‘ডেল্টা নিয়ে বিশ্বে বর্তমানে অনেক উদ্বেগ রয়েছে। এ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও উদ্বিগ্ন।’
করোনার ডেল্টা ধরনকে শুরুতে ভারতীয় ধরনই বলা হতো। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে এই ধরনটির নতুন নাম দেওয়া হয় ‘ডেল্টা ভেরিয়েন্ট’। ধরনটির বৈজ্ঞানিক নাম (বি.১. ৬১৭)। গত মে মাসে করোনার ডেল্টা ধরনকে ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ডব্লিউএইচও।
৮ মে জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটায় (জিআইএসএআইডি) বাংলাদেশে করোনার এই ধরন শনাক্তের খবর দেওয়া হয়। সম্প্রতি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানায়, দেশে দুই মাসে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা করে ৮০ শতাংশে ডেল্টা ধরন পাওয়া গেছে।
বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ১৮ কোটি ২৫ লাখ ছাড়িয়েছে
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ কোটি ২৫ লাখ ছাড়িয়েছে। আর মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিস্টেম সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (সিএসএসই) তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ২৫ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৬ জনে। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার ৯১১ জনের।
বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রে। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৭৮ হাজার ২৭০ জন। আর এই মহামারিতে দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে ৬ লাখ ৫ হাজার ১২ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের পর মৃত্যু বিবেচনায় করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ব্রাজিল। আক্রান্তের দিক থেকে তৃতীয় ও মৃত্যু বিবেচনায় দেশটির অবস্থান দ্বিতীয়। লাতিন আমেরিকার এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৮৬ লাখ ২২ হাজার ৩০৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার ৯৫ জনের।
আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারত মৃত্যু বিবেচনায় আছে তৃতীয় স্থানে। এ পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ৪ লাখ ১১ হাজার ৬৩৪ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৪৫৯ জনের।
মৃত্যু বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী মেক্সিকো চতুর্থ স্থানে আছে। আক্রান্ত বিবেচনায় দেশটির অবস্থান ১৫ নম্বরে। মেক্সিকোতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ লাখ ১৯ হাজার ২৬৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৪৭ জনের।
মৃত্যু বিবেচনায় পেরু আছে পঞ্চম স্থানে। আক্রান্ত বিবেচনায় দেশটির অবস্থান ১৮ নম্বরে। পেরুতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লাখ ৫২ হাজার ৬৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৩৩১ জনের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩২
আপনার মতামত জানানঃ