কানাডায় রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রায় বয়স্কসহ দুর্বল মানুষদের জন্য তৈরি হয়েছে মারাত্মক উদ্বেগ। দেশটির সবেচেয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশে গত পাঁচদিন ধরে চলা তাপদাহে প্রায় পাঁচশ’ মানুষের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
হিটস্ট্রোক ও গরমজনিত বিভিন্ন কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যের প্রধান মর্গের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা লিসা লাপোয়িন্তে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। তাপমাত্রা হ্রাস না পেলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বের শীতলতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম কানাডায় সাধারণত জুনের শেষ সপ্তাহেই গ্রীষ্মকাল শেষ হতে থাকে, আগমনের প্রস্তুতি নিতে থাকে শীত। শীতকালে দেশটিতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়। প্রতি বছর এই চিত্র দেখেই অভ্যস্ত কানাডার জনগণ। এর আগে জুন মাসে কানাডায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
লিসা লাপোয়িন্তে জানিয়েছেন গত শুক্রবার থেকে শুরু করে বুধবার বিকেল পর্যন্ত তারা ৪৮৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছেন। তার মতে এই হিসাব প্রাথমিক। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সম্প্রতি ‘হিট ডোম’-এর প্রভাবে কানাডার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার লিটন এলাকায় রবিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। [বায়ুমণ্ডলে সাগরের উষ্ণ বায়ু আটকে পড়লে যে উচ্চ চাপ তৈরি হয় তাকে হিট ডোম বলা হয়।]
কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে দেশটির ৮৪ বছর পুরনো সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে গেছে। শুধু কানাডা নয়, তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও। কানাডার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন পাঁচ দিনে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় সাধারণত ১৬৫ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু তাপপ্রবাহের কারণে তা ১৯৫ শতাংশ বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে লিসা লাপোয়িন্তে বলেন, এর মধ্যে কী পরিমাণ তাপপ্রবাহের কারণে মারা গেছে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন হলেও ধারণা করা হচ্ছে যেসব মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকেরই মৃত্যু হয়েছে তাপপ্রবাহের কারণে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মধ্যাঞ্চলের শহর লাইটনে এই সপ্তাহে তিনবার রেকর্ড তাপমাত্রা শনাক্ত হয়েছে। গত মঙ্গলবার সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছায় ৪৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
মেট্রো ভ্যানকুভার পুলিশ গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জানায় শুক্রবার তাপপ্রবাহ শুরুর পর কর্মকর্তারা অন্তত ৬৫টি আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় সাড়া দিয়েছে। এছাড়া বৃহত্তর ভ্যানকুভার এলাকার বার্নাবি এবং সারে শহরেও বহু মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতদের অনেকেই বয়স্ক ব্যক্তি।
কানাডার চলতি বছরের আবহাওয়া বিগত বছরের সব চিত্র উল্টেপাল্টে দিয়েছে। ২৬ জুন থেকে দেশটির ব্রিটিশ কলম্বিয়াসহ দেশটির ১০ টি রাজ্যেই শুরু হয়েছে ব্যাপক তাপপ্রবাহ। গত চার দিন ধরে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা দেখা গেছে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার লিটন শহরে। টানা চারদিন এই শহরটির তাপমাত্রা ৪৯ এবং ৪৯.৫ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে।
এছাড়া, কানাডার অধিকাংশ এলাকায় তাপমাত্রা বর্তমানে ৪০ থেকে ৪৬ ডিগ্রির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির আবহাওয়া দফতর ‘এনভায়র্নমেন্ট কানাডা’। ‘এনভায়রনমেন্ট কানাডা’-এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ইতোমধ্যে দেশের ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, অ্যালবার্টা, সাসকাচুয়ান, নর্থওয়েস্টার্ন টেরিটোরিস এবং ইউকন রাজ্যের কিছু এলাকায় অতিরিক্ত তাপমাত্রাজনিত সতর্কতা জারি করেছে।
‘এনভায়রনমেন্ট কানাডা’ কানাডা জনসাধারণকে ঘরে থাকতে আর প্রচুর পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া পরিবারের বয়স্কদের নিয়মিত খোঁজ খবর নেয়ার তাগিদ দিয়েছে তারা।
‘এনভায়রনমেন্ট কানাডা’-এর সিনিয়র জলবায়ুবিদ ডেভিড ফিলিপস বলছেন, আমরা পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শীতপ্রবণ দেশ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বরফ পড়ে, এমন একটি দেশ। এখানে মাঝেমধ্যে শৈত্যপ্রবাহ বা তুষার ঝড় হয়ে থাকে, কিন্তু এরকম উষ্ণ তাপমাত্রা এখানে প্রায় কখনোই দেখা যায় না।
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বৃহত্তম শহর ভ্যানকুভারের অধিকাংশ মানুষ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে মাঝারি ও কমদামী হোটেলসমূহে আশ্রয় নিতে ছুটছেন এবং এর কারণ একটাই, তা হলো শীত প্রধান দেশ কানাডার অনেক বাড়িতে শীতাতপ যন্ত্র (এসি) নেই। শহরের ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানগুলোতে বিক্রির জন্য রাখা সব এসি ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। পুরনো এসিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কানাডার অনেক এলাকায় এখন একটি পুরনো এসি সর্বনিম্ন দুই হাজার ডলারে বিক্রি হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ