বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রতি ১২ জনের মধ্যে একজন ডিমেনশিয়ায় (স্মৃতিভ্রংশ) আক্রান্ত। নারীদের মধ্যে সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় ডিমেনশিয়ার প্রকোপ আড়াই গুণ বেশি। আইসিডিডিআরবি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলের ২ হাজার ৭৯৬ জন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির ওপর গবেষণাটি চালানো হয়েছে। বুধবার ‘বাংলাদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার ব্যাপকতা: জাতীয় সমীক্ষার ফলাফল’ শীর্ষক একটি ওয়েবিনার হয়েছে। সেখানে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।
ওয়েবিনারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম প্রধান অতিথি হিসেবে এবং আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ এবং ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক কাজী দ্বীন মোহাম্মদ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ওয়েবিনারের সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।
ডিমেনশিয়া হলে স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং প্রতিদিনের কাজ করার করার ক্ষমতা কমে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের ডিমেনশিয়া রয়েছে এবং তাদের ৬০ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বসবাস করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১২ জন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির মধ্যে একজন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। নারীদের মধ্যে সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় ডিমেনশিয়ার প্রকোপ আড়াই গুণ বেশি। দেশের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় রাজশাহী (১৫ শতাংশ) ও রংপুরে (১২ শতাংশ) ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বেশি।
সমীক্ষার ফলাফলের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা কখনও স্কুলে যায়নি এবং যাদের স্ত্রী বা স্বামী নেই সামগ্রিকভাবে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ তাদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে বেশি দেখা গেছে।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্ধেকেরও বেশি হাইপারটেনশন (৫২ শতাংশ), হতাশা (৫৪ শতাংশ), এবং ডায়াবেটিস (৮ শতাংশ) সহ এক বা একাধিক দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা (মাল্টিমর্বিডিটি) ছিল।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি পুষ্টির অভাব (৩৫ শতাংশ কম ওজন), স্বল্প শারীরিক ক্রিয়াকলাপ (৪৯ শতাংশ), উচ্চমাত্রায় লবণ গ্রহণ (৫৬ শতাংশ) এবং উচ্চমাত্রায় তামাক সেবন (৭৬.৬ শতাংশ) করতে দেখা গেছে যা সাধারণত নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বা এনসিডি ঝুঁকির কারণ।
সমীক্ষায় অনুমান করা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ডিমেনশিয়া রোগের সংখ্যা ছিল ১.১ মিলিয়ন। তাদের মধ্যে ০.২৮ মিলিয়ন পুরুষ এবং ০.৮৮ মিলিয়ন নারী। একইসঙ্গে গবেষণা দেখা গেছে, ২০২৫ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ১.৩৭ মিলিয়নে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণেরও বেশি হবে (২.৪ মিলিয়ন)। যদি উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় সবারই (৯০ শতাংশ) গত ৬ মাসে স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হয়েছে বলে জানা গেছে এবং তারা চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে (১২ শতাংশ) ও সরকারি হাসপাতালের (৫.৪ শতাংশ) যোগ্য ডাক্তারদের চেয়ে প্রায়ই কোনো ওষুধ বিক্রেতার কাছে (১৬.৬ শতাংশ) গিয়েছিলেন। এই স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ধরনটি রোগীদের লিঙ্গভিত্তিক, বসবাসের স্থান (নগর বা গ্রামীণ অঞ্চল) ভিত্তিক কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি।
গবেষণার গুরুত্ব প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক এবং গবেষণার কো-পিআই অধ্যাপক ড. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘সমাজের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে, তাই খুব বিলম্বে রোগ নির্ণয় হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগী হয়ে আমাদের ডিমেনশিয়া নিয়ে আরও গবেষণা চালানো দরকার, যাতে আমরা ডিমেনশিয়া বৃদ্ধির কারণ শনাক্ত এবং এটির উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি।’
করোনা নিয়ে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘বিশেষত বহু রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিরা কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। তবুও আমাদের কাছে প্রবীণদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সামগ্রিক পরিষেবা মডেল নেই। তাই, সরকারি, বেসরকারি এবং গবেষণা সংস্থার প্রচেষ্টায় এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য একটি সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।’
আইসিডিডিআর,বি-র ইনিশিয়েটিভ ফর নন-কমিউনিকাবল ডিজিজ ইউনিটের প্রধান এবং গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ড. আলিয়া নাহিদ গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ নাগরিকের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছি এবং ডিমেনশিয়ার প্রকোপ অনুমান করেছি। বার্ধক্য অনস্বীকার্য, এজন্য বয়স্ক ব্যক্তির যত্নকে কেন্দ্র করে সহানুভূতিশীল সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের গবেষণার তথ্য-উপাত্তগুলো প্রচলিত বায়োমেডিক্যাল পদ্ধতির বাইরে এক বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা মডেল তৈরি করতে সহায়তা করবে।’
গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে, বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের পরিবার, সমাজ, বেসরকারি এবং সরকারি পর্যায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি এদেশে একটি উদ্ভাবনী স্থানীয় প্রমাণভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ কমানো যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ