আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিউ) আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তা সূচকে এশীয়–প্রশান্ত অঞ্চলে ৮১ দশমিক ২৭ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম এবং ৯৭ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট নিয়ে ভারতের অবস্থান ৪র্থ।
সম্প্রতি গ্লোবাল সাইবার সিকিউরিটি ইনডেক্স–২০২০ সূচক প্রকাশ করেছে আইটিইউ।
গত বছরের তথ্যের ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে। সূচকে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশের অর্জন ৮১ দশমিক ২৭। সূচকের তালিকায় স্থান পাওয়া দেশগুলোর মৌলিক সাইবার হামলা প্রতিরোধে প্রস্তুতি এবং সাইবার হামলার ঘটনা, অপরাধ ও বড় ধরনের সংকট ব্যবস্থাপনায় তৎপরতা মূল্যায়ন করে সূচকটি তৈরি করেছে আইটিইউ।
মোট পাঁচটি বিষয়কে ভিত্তি ধরে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বের ১৯৪টি দেশের সাইবার নিরাপত্তায় গৃহীত আইনি ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সাংগঠনিক ব্যবস্থা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা পরিস্থিতির বিবেচনা করে গত মঙ্গলবার ‘গ্লোবাল সাইবার সিকিউরিটি ইনডেক্স-২০২০’ প্রকাশ করা হয়েছে।
আইটিইউয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সূচক অনুযায়ী, ১০০ পয়েন্ট পেয়ে প্রথম অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ৯৯ দশমিক ৫৪ পয়েন্ট পেয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরব এবং ৯৯ দশমিক ৪৮ স্কোর পেয়ে তৃতীয় হয়েছে ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়া।
এশীয়–প্রশান্ত অঞ্চলের সূচকে বাংলাদেশ ১১তম অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৫২ পয়েন্ট পেয়ে যৌথভাবে প্রথম অবস্থানে রয়েছে কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর। মালয়েশিয়া ও জাপান যথাক্রমে ৯৮ দশমিক ৬ এবং ৯৭ দশমিক ৮২ স্কোর পেয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এই সূচকে প্রতিবেশি ভারত রয়েছে চতুর্থ স্থানে। দেশটির পয়েন্ট ৯৭ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট। আর ৬৪ দশমিক ৮৮ পয়েন্ট পেয়ে ১৪তম স্থানে রয়েছে পাকিস্তান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ, বেনিন, রুয়ান্ডা এবং তানজানিয়ার মতো বেশ কয়েকটি দেশ এগিয়ে এসেছে, যারা শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতিশীল অবস্থান দেখাতে পেরেছে।’
আইটিউ বলছে, এই দেশগুলো জাতীয় পর্যায়ে সাইবার নিরাপত্তা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে, যা সক্ষমতা উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
বাংলাদেশের সরকারের বিজিডি ই-গভ সার্ট এর প্রকল্প পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা সাইবার নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশের ধারাবাহিক সক্ষমতারই প্রতিফলন, যা ভবিষ্যতে আরো দক্ষতার সাথে সাইবার হামলা প্রতিহত করতে উৎসাহিত করবে’।
করোনাকালে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখেও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে প্রযুক্তি। আবার এটাও বলা হচ্ছে, করোনা–পরবর্তীকালেও মানুষের ব্যক্তি ও পেশাজীবনকে নতুনভাবে প্রভাবিত করবে প্রযুক্তি। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে এবং বাড়বে, ততই হুমকিতে পড়ছে এবং পড়বে সাইবার নিরাপত্তা। অনলাইনে নানা রকম ফাঁদ পেতে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বিশ্বজুড়েই।
সম্প্রতি ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২১’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, সাইবার অপরাধের ধরনের মধ্যে অনলাইনে হ্যাকিংয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি, ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০১৮ সালে যা ছিল ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বেড়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) আগের গবেষণায় এমন অপরাধ ছিল ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ, এবার তা হয়েছে ১১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
এটিএম কার্ডের তথ্য হ্যাকড নতুন অপরাধ হিসেবে যুক্ত হয়েছে। অনলাইনে যৌন হয়রানিমূলক বিষয়বস্তু ব্যবহার করে হয়রানির মাত্রা বেড়েছে। অপরাধের মাত্রাটি আগের ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে এবার হয়েছে ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অপপ্রচার কমেছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের ৮৬ দশমিক ৯০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। নারী ভুক্তভোগী ৫৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং পুরুষ ৪৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে ভুক্তভোগী সবচেয়ে বেশি।
গবেষণায় উঠে এসেছে ৬৪ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক আইন সম্পর্কে জানে। কিন্তু ৭৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ অভিযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যায়নি। এ ছাড়া ৭২ দশমিক ২২ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পাননি বলে জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশেও এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটছে অহরহ।
ক্রাইম সার্ভে অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যে ২০১৯ সালে ৩৮ লাখ অনলাইন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যা দেশটিতে মোট অপরাধের এক-তৃতীয়াংশ। ২০১৭ সালে দেশটি এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ শুরু করার পর থেকে প্রতিবছর সাইবার জালিয়াতির ঘটনা বাড়তে দেখেছে। সেখানে প্রায় ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এ জালিয়াতির শিকার হন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি মানুষ এক হাজার ডলারের বেশি অর্থ খুইয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের মতোই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের। গত বছর দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণা ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণায় গত বছর মোট লোকসান হয়েছে ৪২০ কোটি ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
বিভিন্ন দেশের সরকার এখন সাইবার অপরাধ দমনকে অনেক গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ র্যানসমওয়্যার ঠেকাতে একটি বিশেষ দলকে নিয়োগ দিয়েছে। এ ছাড়া ‘ফাইভ আইজ’ নামের একটি জোট গঠন করেছে কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড। তারা সাইবার অপরাধ ঠেকাতে পারস্পরিক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করে থাকে। সাইবার অপরাধীদের ঠেকাতে আরও দূর যেতে হবে বলেই মনে করছেন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে তো অবশ্যই, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশেও প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক গুণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে আমরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তাব্যূহ ভেঙে জালিয়াতির অনেক ঘটনাও জানতে পেরেছি। তীব্র আশঙ্কা ভবিষ্যতে এই নিরাপত্তাঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে। তার জন্য সাবধান হওয়ারও এখনই সময়।
নিয়মিত তথ্য বা ইনফরমেশন সিকিউরিটি রিভিউ করা, ইনফরমেশন সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা, ইনফরমেশন সিকিউরিটি নিশ্চিন্তে ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট ও পেনিট্রেশন টেস্ট বা এথিক্যাল হ্যাকিং করে দেখা, ব্যক্তিগত ই-মেইলের সঙ্গে অফিসের ই-মেইল মিলিয়ে না ফেলা, অফিসের তথ্য আদান-প্রদানে ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার না করা, নিয়মিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর প্রযুক্তি নিরাপত্তা নজরদারি এবং প্রযুক্তি নিরীক্ষা আমাদের এ ক্ষেত্রে অনেক রক্ষাকবচ দিতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১০
আপনার মতামত জানানঃ