
আপনি কার্ল লুতজ এবং অস্কার শিন্ডলারের নাম নিশ্চই শুনেছেন। এই দু’জনই দ্য হলোকাস্টের সময় ইহুদিদের বাঁচানোর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, নাৎসিদের গণহত্যা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অধিকৃত ফ্রান্সে কিছু মুসলিম কর্মকর্তা প্রায় ২০ হাজার এথিনিক ইহুদিদের বাঁচিয়েছিলো?
দ্য হলোকাস্ট বা ইহুদি গণহত্যার অনেক নায়কই অমর হয়ে আছেন সিনেমা এবং বইয়ের পাতায়। যদিও তুর্কি সাহসী মুসলিমদের কেউ সেভাবে মনে রাখেনি। কিন্তু এখন গোটা বিশ্বে ইসলামফোবিয়া ত্রাস হয়ে উঠছে এবং একই সাথে মুসলমানদের বিপক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে এই ফোবিয়া, তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্ব হয়ে পড়ে ইতিহাস থেকে এমন কিছু ঘটনা মানুষের সামনে তুলে ধরতে, যেখানে আজকের দিনের শত্রুপক্ষরা একসময় একই মানবিক বিশ্বাসে এক হয়েছিলো, একে অন্যকে সাহায্য করেছিল।
বেহিচ এরকিন এমনই এক সুপারহিরো, যিনি হলোকাস্টের সময়ে ইহুদিদের বাঁচাতে নিজেদের জীবন বিপদে ফেলতেও ভয় পায়নি। ১৯৩৯ সালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরকিনকে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন। এরকিন ফ্রান্সে পৌঁছান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরকিন প্যারিসের ৫ হাজারেরও বেশি তুর্কি ইহুদিদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, যারা কিনা যেকোনও মুহূর্তে গ্রেফতার হতে পারতো। জার্মানিরা ফ্রান্স দখল করে নিলে, প্যারিস থেকে সরকার সরিয়ে নিতে হয় ফ্রান্সকে। তুরস্কের দূতাবাসও সরাতে হয়। তবে প্যারিসে বসবাসরত তুর্কি ইহুদিদের রক্ষা করতে, এরকিন পাঁচজন কর্মচারী নিয়ে প্যারিসে ছোট একটা দূতাবাস চালু রাখতে জোর দেন।
এরকিন নিজের পলিটিক্যাল অবস্থান কাজে লাগিয়ে সেইসব ইহুদিদের খুঁজে বের করতেন, যাদের কোনও না কোনওভাবে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক ছিলো, তা যতো সামান্যই হোক না কেন। এমন ইহুদিদের খুঁজে বের ক’রে এরকিন তাদের তুরস্কে স্থানান্তর করাতেন। এভাবেই তিনি অসংখ্য ইহুদিদের নাৎসি গণহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিলো।
কিছু মহলের দাবি, এরকিন প্রায় ৩ হাজার ইহুদিদের বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলো।
ফ্রান্সে জার্মান অকুপেশনের শুরুর দিকে, নাৎসিরা ইহুদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতো, দোকান বা কারখানার বাইরে ‘ইহুদি’ লেখা বোর্ড ঝুলিয়ে রাখতে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া হবার এবং মালিকদের নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচাতে, তুর্কি ইহুদিদের এরকিন প্রতিষ্ঠানের বাইরে ‘তুর্কি জাতীয়তা’র বোর্ড ঝোলাতে বলেন। তুর্কি দূতাবাস আশা করছিলো, যেহেতু তুরস্ক যুদ্ধে নিরপেক্ষ দেশ ছিলো, তাই নাৎসিরা তুর্কি ইহুদিদের কোনও ক্ষতি করবে না। পাশাপাশি তারা তুরস্কের সাথে কোনও প্রকার সম্পর্ক থাকা ইহুদিদের তুরস্কের নাগরিকত্ব গ্রহণেও উৎসাহিত করতো। এই ক্ষেত্রে বেহিচ এরকিনের ভূমিকা কখনও ভোলার নয়।
যুদ্ধ শুরু হলে, তুর্কি কর্মকর্তারা তাদের ইহুদি নাগরিকদের বাঁচাতে তৎপর হয়ে ওঠেন। ১৯৪২ সালের শেষ দিকে, জার্মানিরা নিরপেক্ষ দেশের সব ইহুদিদের তাদের নিজ নিজ দেশে স্থানান্তর করার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যখন একের পর এক পারসিয়ান ইহুদিদের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে রাখা হচ্ছিল, এরকিন জার্মানির রাষ্ট্রদূতের সাথে উচ্চ-পর্যায়ে বৈঠকের মাধ্যমে বারবারই ইহুদিদের ফ্রান্স থেকে সরিয়ে নে’য়ার সময়সীমা বাড়াচ্ছিলেন। এরকিন এই সুযোগটা গ্রহণ করেন এবং উদ্বাস্তুদের নিরাপদে তুরস্কে পাঠানোর জন্য প্রথম ট্রেনের বন্দোবস্ত করেন। ট্রেনটি সাজানো ছিলো তুর্কি পতাকা দিয়ে। এরকিনের পরিকল্পনার জন্য ইহুদিদের একটা বড় অংশ নিরাপদে ফ্রান্স ত্যাগ করে এগারো দিন পর তুরস্কে পৌঁছায়।

এখানেই থেমে থাকেননি এরকিন। তিনি আরও বেশ কয়েকটি ট্রেনের বন্দোবস্ত করেন। এমনকি যারা তুর্কি নয়, তিনি তাদেরও ফেরাননি। তুরস্কের সাথে সম্পর্ক নেই এমন অসংখ্য ইহুদিদের তিনি বাঁচিয়েছেন। ঐতিহাসিক নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এই ইহুদিদের স্থানান্তরে তুরস্ক কোনভাবেই যুক্ত ছিলো না। কিছু তুর্কি কূটনীতিক নিজেদের উদ্যোগে এই কাজ করেন।
যখন ট্রেনে করে ইহুদিদের সরিয়ে নেয়ার বিষয়টা সামনে আসে, তখন দূতাবাসের সামনে অসংখ্য ইহুদিরা তুরস্কের নাগরিকত্বের জন্য ভীড় জমায়। এটা খুবই বিপদজনক কাজ ছিলো। ততোদিনে ইহুদিদের উপর নাৎসিদের অত্যাচার ছাড়িয়ে গেছে সমস্ত সীমা। তাই যেকোনও সময়েই দূতাবাসের বাইরে ভীড় করা ইহুদিদের আটক করতে পারতো নাৎসিরা। এমনকি এই সরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম বন্ধ করতে পারতো। বিশেষত কিছু ইহুদিরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদিন করেছিলো, যাদের তুরস্কের সাথে কোনও সম্পর্ক ছিলো না। এটা পুরো প্রক্রিয়াটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। যদিও এরকিন দূতাবাসকে অনুরোধ করেছিলেন, তারা যেন সাহায্য করা সম্ভব, এমন কাউকেই ফিরিয়ে না দেয়।
যদিও সেই সময়ে যেসব তুর্কি ইহুদিদের নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচানো হয়েছিলো, তাদের যথাযথ সংখ্যাটা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে কিছু মহলের দাবি, এরকিন প্রায় ৩ হাজার ইহুদিদের বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলো। সংখ্যাটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মুসলিম এবং ইহুদিদের ইতিহাসে বেহিচ এরকিন একজন সুপার হিরো।
সূত্র:
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]

আপনার মতামত জানানঃ