কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে চলা সৌদি সমাজেও শেষ পর্যন্ত পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। আর এই পরিবর্তন আসছে ক্রাউন প্রিন্স মোহামেদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ এর হাত ধরে। ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল ইসলামী দেশ হিসেবেই পরিচিত সৌদি আরব। দীর্ঘদিনের এই গোঁড়ামির খোলস ভাঙতে শুরু করেছে দেশটি। নারীদের উপর থেকে শিথিল হচ্ছে বিধিনিষেধ। নিজস্ব পরিচিতি তারা তৈরি করার অধিকার পেয়েছে। চলচ্চিত্র, গান নিয়ে দেশটির দীর্ঘদিনের কড়াকড়িও শিথিল করা হয়েছে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত সিনেমা হল, মিউজিক শো নিয়ে পরিকল্পনা করছে প্রশাসন। অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতা বাড়ছে দেশটিতে। স্কুলে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ পাঠের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এমনকি অন্যে যাতে বিরক্ত না হয়, মসজিদে মাইকের ব্যবহারের উপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে দেশটি। যদিও এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশে ঘটলে, এতোদিনে দাঙ্গা হয়ে যেত দু’একটি।
পুরুষের কর্তৃত্ব থেকে নারীদের মুক্তি
সম্প্রতি পুরুষের কর্তৃত্ব থেকে নারীকে মুক্ত করার এক যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। দেশটির শরিয়া আদালতের ১৬৯ ধারার ‘বি’ অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে। ওই বিধান অনুসারে অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত ও প্রাপ্ত বয়স্ক বিধবা মহিলাদের অবশ্যই একজন পুরুষ অভিভাবকের হেফাজতে থাকতে হতো।
এখন থেকে সৌদি আরবে অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবা মহিলারা বাবা বা অন্য কোন পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পছন্দের বাড়িতে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারবে।
দেশটির বিচারিক কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করেছে। সংশোধনী ওই আইনে বলা হয়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী কোথায় থাকবেন সেটা নির্ধারণ করার অধিকার তার রয়েছে।
পুরুষের অভিভাবকত্ব ছাড়া হজ করার অধিকার নারীদের
সৌদি নারীদের পুরুষ অভিভাবক অর্থাৎ কারো স্ত্রী, মা, বোন ইত্যাদি পরিচয় নিয়েই তবে হজের জন্য নিবন্ধন করতে হতো। তবে এখন পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই হজের জন্য নিবন্ধিত হতে পারবেন দেশটির নারীরা।
সৌদি হজ ও ওমরা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই হজের জন্য নারীদের নিবন্ধনের অনুমতি দিয়েছে সৌদ আরব। অর্থাৎ মাহরাম (পুরুষ অভিভাবক) ছাড়াই নারীরা এখন থেকে হজ করতে পারবেন।
সম্প্রতি সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ দেশটির শরিয়া আইনের আর্টিকেল ১৬৯ এর বি ধারাটি বাতিল করে। যেখানে লেখা ছিল বিবাহিত, অবিবাহিত ও সেপারেটেড নারীদের তাদের পুরুষ অভিভাবকের অধীনস্থ থাকতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে বাড়ছে নারীদের অংশগ্রহণ
একটা সময় সৌদি আরবের নারীদের বাইরে কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবে শিল্পখাতে কাজ করা নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ হাজার৷
সৌদি আরবের সর্বশেষ শ্রমবাজার জরিপে দেখা গেছে, ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে। যেখানে ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ২৬ শতাংশ।
‘ভিশন ২০৩০’ অনুযায়ী সৌদি শ্রমশক্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ছিল। যদিও এক দশক আগেই সেই লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে দেশটি।
নারী পরিচালিত কারখানা
ইবনে জায়েদ নামের এক খেজুর কারখানায় শুধু নারীরা কাজ করেন৷ প্রায় ১০০ নারী কাজ করেন সেখানে৷ আল-আহসা অঞ্চলে অবস্থিত এই কারখানায় আগে বিদেশি শ্রমিকরা কাজ করতেন৷ ২০১৯ সাল থেকে শুধু নারীরাই কারখানাটি চালাচ্ছেন৷ কারখানার ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে হিসাবরক্ষণ, মান নিয়ন্ত্রণ, প্যাকেজিং সব কাজই করছেন নারীরা। এমনকি ফর্কলিফটও চালায় নারীরা৷
‘ভিশন ২০৩০’ এর আওতায় ২০১৭ সাল থেকে সৌদি আরবে নারীরা অনেক কাজের অনুমতি পাচ্ছেন৷ সে কারণে ইবনে জায়েদ কারখানার মালিক বিদেশি শ্রমিক বাদ দিয়ে ধীরে ধীরে মেয়েদের নিয়োগ দেয়া শুরু করেছিলেন৷
নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি
সৌদি আরবের নারীরা ২০১৭ সালে গাড়ি চালানোর আনুষ্ঠানিক বৈধতা পায়। এর আগে দশকের পর দশক ধরে সেখানে নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। যদিও ২০১৮ সালের জুন মাসের শুরুর দিকে মেয়েদের প্রথম লাইসেন্স দেয়া হয়।
সৌদি আরব ছিল একমাত্র দেশ যেখানে মেয়েদের গাড়ি চালানো নিষেধ ছিল। গাড়ি চালানোর জন্য গাড়ির মালিকদের ব্যক্তিগত চালক রাখতে হত। যদিও ২০০৮ থেকে ২০১১ এবং ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে অনেক নারীকেই দেখা গেছে তারা গাড়ি চালাচ্ছে এমন ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শেয়ার করেছেন।
মসজিদের মাইক ব্যবহারে বিধিনিষেধ
অন্যে যেন বিরক্ত না হয় তাই সৌদি আরবে মসজিদে মাইক ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে সম্প্রতি। আজান ও ইকামাত ছাড়া মসজিদের মাইক ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটির ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি মাইকের আওয়াজ সীমিত করারও নির্দেশ দিয়েছে দেশটি।
সরকারের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী আবদুল লতিফ আল শেখ এ সংক্রান্ত এ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। বিজ্ঞপ্তিতে সৌদি আরবের সব মসজিদে শুধু আজান ও ইকামতের সময় লাউড স্পিকারের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে এবং এর আওয়াজ এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে একটি হাদিসের বরাত দেওয়া হয়েছে। ওই হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সবাই সৃষ্টিকর্তাকে নীরবে ডাকছ। কেউ কাউকে বিরক্ত করা উচিত নয় এবং (সূরা) পাঠ বা নামাজে একজনের কণ্ঠের ওপর কণ্ঠ তোলা উচিত নয়।’
স্কুলে পড়ানো হবে রামায়ণ ও মহাভারত
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে পড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে সৌদির স্কুলে রামায়ণ-মহাভারত পড়ানো হবে। স্কুলে পড়ুয়াদের অন্য বিষয়ের পাশাপাশি রামায়ণ এবং মহাভারতের শিক্ষা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে সৌদি আরব সরকার। সৌদি আরবের পড়ুয়াদের গীতা জ্ঞান এবং ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে পাঠ করানো হবে বলে জানানো হয়েছে।
দেশটির প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান ভিশন ২০৩০ ঘোষণার পর শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের অংশ হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান দিতেই এমন কার্যক্রম হাতে নেন মোহাম্মাদ বিন সালমান।
সৌদি যুবরাজের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশটির প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পাঠ্যসূচিতে বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্কুলপড়ুয়াদের প্রাথমিক ধারণা দেয়া হবে বলে জানা গেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধর্মের পাশাপাশি সৌদি আরবের স্কুল পাঠ্যসূচিতে যোগ করা হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতের পরিচয়।
চলচ্চিত্রের ওপর থেকে তুলে নেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা
সৌদি আরবে ৩৫ বছর নিষিদ্ধ ছিল চলচ্চিত্র৷ ২০১৮ সালে চলচ্চিত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় সৌদি আরবের সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়৷ সেই থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে নতুন যাত্রা শুরু করেছে চলচ্চিত্র শিল্প৷
আরব চলচ্চিত্র শিল্পের বিশেষজ্ঞ, লেবাননের তথ্যচিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক জাইনা স্ফের জানান, ‘‘মহামারি শুরুর আগে প্রতি শুক্রবার শপিং মলগুলোতে থিয়েটারে মুভি দেখতে আসা মানুষদের ভিড় জমতো৷’’
নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার চার মাসের মধ্যেই রিয়াদে খুলে যায় প্রথম সিনেমা হলের দরজা৷ ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল সেই প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয় ‘পিঙ্ক প্যান্থার’৷ নারী এবং পুরুষদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা ছিল, আবার একসঙ্গে বসে চলচ্চিত্র উপভোগের সুযোগও ছিল সেখানে৷ কোনে আসনই খালি ছিল না৷ ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ৩৫০টি সিনেমা হল এবং ২৫০০ মুভি স্ক্রিন তৈরির লক্ষ্য স্থির করেছে ক্রাউন প্রিন্স সালমানের সরকার৷
রেস্টুরেন্টে গান বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল
সৌদি আরবের রেস্টুরেন্টে এখন শোনা যায় গান। সৌদি আরবের বর্তমান ক্ষমতাসীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেশে অনেক সংস্কার কাজ করছেন। রেস্টুরেন্টে গান বৈধ করা তেমনই একটি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য মিডল ইস্ট আইয়ের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবের জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট অথরিটির (জিইএ) প্রধান নির্বাহী এবং সৌদি রাজ দরবারের উপদেষ্টা তুর্কি আল শেখ এই আদেশ জারি করেন।
এমনকি এই অনুমতির পর ২০১৯ সালের বিনোদন ক্যালেন্ডারে কয়েক ডজন ইভেন্ট আয়োজনকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছিল অটো রেস, মিউজিক শো, থিয়েটার পারফরমেন্স ইত্যাদি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০২৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ