দেশের গণমাধ্যমে প্রভাবশালীদের সুবিধার্থে গড়ে উঠেছে সেন্সরশীপ কালচার। দেশের প্রথমসারির পত্রিকা প্রথম আলো থেকে শুরু করে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এই কালচারটাকে চর্চা করে আসছে। আর কেনই বা করবে না! সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪৮টি মিডিয়ার ৪০টির মালিকপক্ষই ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি। দেশের ব্যবসায়িক এই আইকনেরা নিজেদের অপরাধকে ধামাচাপা দিতে ঘটনার মোড় বদলানোর জন্য গণমাধ্যমকে যে চাপ প্রয়োগ করছে এবং করবে, সে তো নতুন কিছু নয়।
তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে চাপে পড়ে নয়, গণমাধ্যম সেল্ফ সেনসরশীপে মাধ্যমে অভিযুক্তদের লাইমলাইট থেকে দূরে রাখে। সম্প্রতি ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টার অভিযোগে, অভিযুক্ত ঢাকা বোট ক্লাবের নির্বাহী সদস্য ও ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকে ‘প্রথম আলো’। ভিক্টিমের পরিচয় প্রকাশ না করার নীতিটা ভোল পাল্টে অভিযুক্তদের মুখ আর চুনকালির মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। সাধারণ মানুষের কাছে, তারা থেকে যাচ্ছে অচেনা।
বাংলাদেশের মিডিয়ায় সেল্ফ সেনসরশীপ খুবই প্রচলিত ব্যাপার এখন। এর অন্যতম কারণ ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট। কঠোর এই অনলাইন আইনে ২০২০ সালে ৭৫ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস এর তৈরি করা স্বাধীন গণমাধ্যমের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে নিচে অবস্থান করছে— ১৫২ তম। এমন পরিস্থিতিতে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির ঘটনায় মিডিয়ার আচারণ খুব বেশি অপ্রত্যাশিত নয়। তবে নাসির উদ্দিন মাহমুদের নাম নেয়া এই আইনে অপ্রাসঙ্গিক। তাই বাধ্য হয়েছে বলে পিঠ এড়াতে পারবে না ‘প্রথম আলো’।
গত রোববার সন্ধ্যা ৭টা ৫৩ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে এই নায়িকা অভিযোগ করেন, যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া রীতিমতো ঝড় ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিচার চেয়ে ওই স্ট্যাটাসের শুরুতে তিনি লেখেন, ‘আমাকে রেপ এবং হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমি এর বিচার চাই।’ স্ট্যাটাস দেখার পর পর গণমাধ্যম কর্মীরা তার বনানীর বাসায় গিয়ে জড়ো হন। সেখানে সাংবাদিকদের সামনেই অভিযুক্তের নাম ও কখন, কোথায় তাকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয় তার বর্ণনা দেন। তবুও ‘প্রথম আলো’ অভিযুক্ত ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ সম্পর্কে প্রমাণ না থাকায় নাম নেয়া থেকে বিরত থাকে। যদিও অহরহ বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত এবং ভুক্তভোগীদের নাম ঠিকানা প্রথম আলোতে উঠে আসছে।
অভিযুক্তদের প্রতি গণমাধ্যমের এই ‘ভাসুরের নাম মুখে নেয়া যাবে না’ কালচার একদিনে গড়ে ওঠেনি। চলতি বছর এপ্রিলের ২৭ তারিখ ঢাকার অভিজাত এলাকায় ২১ বছর বয়সী এক কলেজ ছাত্রী আত্মহত্যা করে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর। আনভীরের ব্যবসায়িক দৌড়, সাধারণের চার ফুট বাই ছ’ফুট খাটে শুয়ে দেখা স্বপ্নের চেয়ে অনেক বড়। সিমেন্ট থেকে শুরু করে রিয়েল এস্টেট, শপিং মল থেকে শুরু করে কনভেনশন সেন্টার, তরলিত পেট্রোলিয়াম গ্যাস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন পণ্য। এই সমস্ত কিছুই আনভীরকে প্রতিনিয়ত ক্ষমতার নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া আনভীরের মামলার সাথেও জড়িত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়কে গোপন করতে থাকে। আনভীরের নাম, তার পরিচয়, তার চেহারা প্রকাশে নানা তালবাহানা শুরু করে। যেখানে ভুক্তভোগী মেয়েটিকে এবং তার পরিবারকে গোপন রাখার নিয়ম থাকলেও, আনা হয় প্রকাশ্যে। বুলিংয়ের সুযোগ করে দে’য়া হয়। প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় তার চরিত্রকে। বাংলাদেশের প্রথম সারির টিভি চ্যানেল, ‘সময় টিভি’, আনভীরকে আলোচনার টেবিল থেকে সরাতে, ভিক্টিম মেয়েটিকে দোষী দেখাতে ছয়টি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রশ্ন তোলে, মেয়েটির প্রেমিকের সংখ্যা নিয়ে এবং কীভাবে এমন অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া ক’রে থাকত তা নিয়ে। বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’ ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের এই স্বর্ণযুগে গা ভাসিয়ে, তাদের একটি প্রতিবেদনে ভিক্টিমের ছবি ব্লার না ক’রে সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী আনভীরের ছবি ব্লার করে প্রচার করে। যদিও চ্যানেল আই এই ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং টেকনিক্যাল এররের জন্য এমন হয়েছে বলে জানায়।
তবে পুলিশের বিবৃতি, ভিক্টিম মেয়েটির বোনের করা মামলার কপি এবং কোর্ট অর্ডারের পরও কিছু মিডিয়া আনভীরের নাম সামনে আনতে চায়নি। এর দ্বারা বাংলাদেশের মিডিয়ার উপর কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে সারা দেশের মানুষের কাছে, এমনকি তা লক্ষ্য করেছে গোটা বিশ্ব। আবারও গণমাধ্যমের এই চেহারা আমাদের সামনে আসল। কিন্তু চিত্রনায়িকাকে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টা মামলায় ঢাকায় গ্রেফতার এই নাসির উদ্দিন মাহমুদ ওরফে নাসির ইউ মাহমুদ কে? গণমাধ্যম কেনই বা তাকে আড়াল করছে? কতটা প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ী?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার বাড়ি ঝালকাঠিতে। ঝালকাঠি শহরের কলেজ মোড়ে তার পৈত্রিক বাড়ি। তবে তার বেড়ে ওঠা বরিশাল শহরে। তার বাবা মো. হারুন রশীদ পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন। সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে অনেক বছর আগে অবসরে যান। বরিশাল শহরের বগুড়া রোডে তাদের বসবাস ছিল। নাসির উদ্দিন মাহমুদের চাচা বেলায়েত হোসেন দীর্ঘদিন ঝালকাঠি পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।
নাসির উদ্দিন মাহমুদ পটুয়াখালী জুবিলী স্কুল, বরিশাল জিলা স্কুল এবং বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র ছিলেন। ১৯৭৫/৭৬ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। ঝালকাঠি শহরের রোনালসে রোডের বিউটি মঞ্জিল নাসির উদ্দিন মাহমুদের শ্বশুরালয়। তার শ্বশুর মৃত আব্দুর রশিদ ঠিকাদার ছিলেন।
নাসির উদ্দিন মাহমুদ ব্যবসার প্রথম জীবনে ঝালকাঠি এবং বরিশাল শহরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঠিকাদারি করতেন। নব্বই দশকের শেষের দিকে তিনি ঢাকায় স্থায়ী হয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদ গ্রেফতার এড়াতে পরীমনিরই ‘বন্ধু’ অমির বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। এসময় তার সঙ্গে ৩ নারীকে পাওয়া গেছে। নাসিরের সঙ্গে গ্রেফতার অল্পবয়সী তিন নারীর মধ্যে অমির গার্লফ্রেন্ড স্নিগ্ধা ও নাসিরের সঙ্গী লিপি ও সুমি রয়েছেন। সূত্র মতে, গতকাল সোমবার দুপুরে উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডস্থ বাসাটি থেকে নাসিরসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
নাসিরের গ্রেফতারের বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অমির বাসা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন নাসির। পরীমণির সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে নাসির তার তিন রক্ষিতাকে নিয়ে এ বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। ওই বাসা থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ-বিয়ার ও এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে পুলিশ। মাদক রাখার অভিযোগে ওই তিন জনকেও আমরা গ্রেফতার করেছি। তাদের কাজই মদের ব্যবসা করা। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন নাসির। তিনি এই কাজই করেন। তিনি বিভিন্ন ছোট ছোট মেয়েকে রক্ষিতা রাখেন। আমরা এখনও তদন্ত করছি।’ পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অমির ওই বাসায় প্রতিদিন ডিজে পার্টির আয়োজন করতেন নাসির। উঠতি বয়সী তরুণীদের দিয়ে অনৈতিক কার্যকলাপ করানো হতো। বাড়িটিতে যাতায়াত ছিল অনেকের।
নাসিরের বিরুদ্ধে আগেও মাদক ও নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ। বলেন, ‘মাদক ও নারী নির্যাতনসহ নানা অভিযোগে তাকে উত্তরা ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জেনেছি। কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আমরা সেগুলোর তদন্ত করব।’
এখানে বলা যায়, অভিযুক্ত এই নাসির অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত এবং একই সাথে ধনী ও প্রভাবশালী। তাই কোন অভিযোগ ভাইরাল না হলে, তাকে গ্রেফতার করা যায় না কিংবা অভিযোগ প্রমাণিত না হলে ‘প্রথম আলো’ তার নাম মুখে নিতে পারে না। এই সময়ে এসে সাধারণ মানুষের পাশে আদতে কেউ নেই। তাদের সমস্যা দেখার কেউ নেই। নেই সরকার, নেই আইন। গণমাধ্যমও নেই। কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে যে মানুষের আগে ‘সাধারণ’ শব্দটা বসানো হয়, তার জন্য জায়গা কোথাও নেই। একজন আর্টিস্ট, বাংলা সিনেমার বেশ জনপ্রিয় এবং পরিচিত মুখ হয়েও ভুক্তভোগী এই নায়িকাকে বিচারের জন্য যেভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হলো, সেখানে আপনার আমার মতো সাধারণদের বিচারের প্রত্যাশা গাঁধার রেস যেতার স্বপ্ন। এই ক্ষেত্রে গণমাধ্যম হতে পারতো বিচারব্যবস্থার পিঠে চাবুকের শব্দ। কিন্তু সে গুড়ে বালি। প্রভাব আর অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে শিরদাঁড়া।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩২৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ