চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে চীনা টিকার দাম প্রকাশ করা নিয়ে এত হৈ চৈ হলেও সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা এখন স্বীকার করছেন যে, চীনের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম কিংবা সিনোভ্যাক কারও সঙ্গেই আজ অবধি বাংলাদেশের কোনো চুক্তি হয়নি। তিন দিন আগে ঢাকায় নিযুক্ত উপ-রাষ্ট্রদূত হুয়ালং ইয়ান এক ফেসবুক বার্তায় বলেছিলেন, চীন পরের কথা, সিনোফার্মের সঙ্গেই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো চুক্তি হয়নি।
জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন, টিকার বিষয়টি নিয়ে জনগণকে সঠিক তথ্য জানানো প্রয়োজন। টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সংকট চলছে। এর সঙ্গে রাজনীতি, কূটনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি সবকিছু যুক্ত হয়ে পড়েছে।
চীনের সঙ্গে জটিলতা
সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান। শিগগির চীনের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত চুক্তি হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, চীনের আরেকটি কোম্পানি সিনোভ্যাকও বাংলাদেশে টিকা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে তারা এই টিকা তৈরিতেও আগ্রহী। সিনোভ্যাকের টিকার জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং দেশে এই টিকা উৎপাদনের জন্যও আলোচনা চলছে।
রাশিয়ার টিকার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে টিকা কেনার চুক্তিটি এখনও খসড়া আকারে রয়েছে। সম্পূর্ণ হয়নি। তারা বাংলাদেশকে টিকা দিতে চায়।
আগের দিন রোববার রাশিয়ার বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে করোনার টিকা দ্রুতই চলে আসবে। চীনের সঙ্গেও কোনো জটিলতা হয়নি। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি চুক্তি হবে। তবে কখন হবে সেটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লাইন করে দিয়েছে, বাকিটা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাজ। টিকা ক্রয় ও যৌথ উৎপাদনে তারা সিদ্ধান্ত নেবে। আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
চীনের কাছ থেকে টিকা কেনার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। চীনকে বলেছি তাদের কাছ থেকে টিকা কিনতে চাই এবং তোমরা কোনো বাধা ছাড়াই জোগান দাও। কোনো বাধা ছাড়াই তারা টিকা সরবরাহের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বেইজিং
চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের টিকার প্রস্তাবিত দাম প্রকাশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বেইজিং। তারা নোট ভারবাল পাঠিয়ে ঢাকার কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়েছে। জবাবে বাংলাদেশের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই দুঃখ প্রকাশ সংক্রান্ত খবর চাউর হওয়ার পর (গত ৫ই জুন) ঢাকাস্থ চীন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন হুয়ালং ইয়ান নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট প্রচার করেন।
চার প্যারার ওই পোস্টে তিনি উষ্মা প্রকাশ করে লিখেন- ‘অবাক লাগছে যে, কেন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব সময় ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে! যদি গণমাধ্যমের তথ্য সঠিক হয়ে থাকে। প্রথমত, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ এবং সিনোফার্মের মধ্যে কোনো চুক্তি হয়নি। দ্বিতীয়ত, এটা আসলে চীন সরকারের সঙ্গে নয়, বরং বাংলাদেশ সরকার এবং সিনোফার্মের মধ্যে একটি কমার্শিয়াল পার্চেইজ বা বাণিজ্যিক কেনাকাটার দরকষাকষি। আমরা প্রবলভাবে চেয়েছি বাংলাদেশি ভাই-বোনেরা তাদের অতি প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন পূর্বনির্ধারিত তারিখেই পাক।’
চীনের সঙ্গে টিকা চুক্তির শর্ত ছিল, দাম প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব টিকার দাম প্রকাশ করায় বিপাকে পড়ে চীন। একই টিকা শ্রীলঙ্কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ১৫ ডলারে। বাংলাদেশে প্রতি ডোজ টিকা ১০ ডলারে বিক্রি নিয়ে আপত্তি জানায় শ্রীলঙ্কা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দাম প্রকাশ করায় চীন তাদের অস্বস্তির কথা বাংলাদেশকে ইতোমধ্যে জানিয়েছে। এরপরই টিকার দাম প্রকাশ করা ওই অতিরিক্ত সচিবকে গত ১ জুন ওএসডি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, মূলত টিকার দাম প্রকাশ করার পর চীন নাখোশ হয়েছে। কারণ, একই টিকা শ্রীলঙ্কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ১৫ ডলারে। শ্রীলঙ্কা বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এতে চীন অস্বস্তিতে পড়ে। মূলত এরপরই ওই কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। ওই বিষয়টি না ঘটলে চলতি জুন মাস থেকেই সিনোফার্মের টিকা আসা শুরু হতো। কিন্তু সংকট যে জায়গায় পৌঁছেছে, তা উত্তরণে পথ খুঁজছে বাংলাদেশ ও চীন। এখন বাংলাদেশকেও ১৫ ডলারে টিকা কিনতে হতে পারে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ফুরিয়ে আসছে টিকার মজুদ
করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকার মজুদ ফুরিয়ে আসছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ডের টিকা কোভিশিল্ড গতকাল বুধবার পর্যন্ত এক কোটি ৫৪ হাজার ৪৩ ডোজ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন। প্রথম ডোজ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪২ লাখ ৩৪ হাজার ২৮ জন। ভারত থেকে কেনা ও উপহার মিলে এখন পর্যন্ত এসেছে এক কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা। এ অবস্থায় সরকারের কাছে টিকার মজুদ আছে মাত্র দুই লাখ ৪৫ হাজার ৯৫৭ ডোজ। ওই টিকা দিয়ে আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
জনমনে বাড়ছে শঙ্কা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, টিকা নিয়ে মন্ত্রীরা বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। কেউ বলছেন, টিকা কেনার চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে। আবার কেউ বলছেন, ড্রাফট পর্যায়ে রয়েছে। এতে করে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সুতরাং সরকারের উচিত এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানানো।
বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, শুরু থেকে টিকার জন্য একটি উৎসের ওপর নির্ভরশীল থাক উচিত হয়নি। বিকল্প উৎস হাতে রাখার প্রয়োজন ছিল। কারণ, একটি উৎস সমস্যা হলে অন্যটি কাজে লাগানো যেত। কিন্তু সেটি না করায় বাংলাদেশ সংকটে পড়েছে। এখন টিকা নিয়ে কী হচ্ছে, কবে নাগাদ চীন অথবা রাশিয়া থেকে টিকা আসবে কিংবা উৎপাদনের যে কথা হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে সুনির্দিষ্টভাবে জানানো প্রয়োজন। অন্যথায় জনমনে আরও শঙ্কা বাড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ