সৌদি আরব থেকে ৬ মাসের ছেলে সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন ৩২ বছরের এক নারী। ওই নারীর দাবি, সৌদি আরবে যে বাড়িতে কাজ করতেন সেই গৃহকর্তা তার সন্তানের বাবা। এখন এই সন্তানকে নিয়ে কীভাবে নিজের বাড়িতে যাবেন তা বুঝতে পারছেন না।
ভাগ্য ফেরানোর আশায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে সৌদি আরব গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের এক নারী। দেড় বছর পর ৬ মাসের ছেলে সন্তান নিয়ে মঙ্গলবার (৮ জুন) সকালে দেশে ফিরেছেন তিনি।
তিনি জানান, সৌদি আরব যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হতেন। এক পর্যায়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলে পরে তাকে সফর জেলে পাঠানো হয়। সফর জেলেই জন্ম হয় আব্দুর রহমান নামের এই ছোট্ট শিশুটির।
ভুক্তভোগী নারী বলেন, আমার পরিবারের কেউ বিষয়টি জানে না। তাকে নিয়ে আমি পরিবারে ফিরতে পারব না। সমাজের লোকেরা ভালোভাবে নেবে না।
বিমানবন্দরে নেমেই কোন উপায় না পেয়ে তিনি বিষয়টি জানান বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের কাছে। এরপর সেখান থেকে এই নারীকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হস্তান্তর করা হয় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কাছে। এই নারী বর্তমানে ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে অবস্থান করছেন।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ভীষণ দুর্ভাগ্যজনক। তবে ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। সৌদি আরবের কোন বাড়িতে তিনি কাজ করতে গিয়েছিলেন, তার নিয়োগকর্তা কে, এগুলো তদন্ত হওয়া উচিত। প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্ট করে সন্তানের পিতৃপরিচয় বের করা উচিত। এর আগে আমরা এ ধরনের ১২টি ঘটনা দেখেছি। তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়ে আমাদের সোচ্চার ও নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।’
এর আগে ২৬ মার্চ সৌদি আরব থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সন্তান দিয়ে দেশে ফেরেন নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার কুমারী শাহনাজ আক্তার। শাহনাজ সৌদি আরবের মক্কাস্থ কেন্দ্রীয় জেলে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় পুত্র সন্তান জন্ম দেন।
তাছাড়া গত ২ এপ্রিল নিজের আট মাসের শিশু সন্তানকে বিমানবন্দরে ফেলেই চলে গেছেন সৌদি আরব ফেরত আরেক মা।
এছাড়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি চার মাসের মেয়ে সন্তান নিয়ে ওমান থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হন সাথী আক্তার নামের আরেক নারী গৃহকর্মী। বিমানবন্দরে পৌঁছার পর সাথী এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ অফিসে গিয়ে বলেন, ‘তার সন্তানের পিতা একজন ওমানি নাগরিক।’ তিনি বলেন, ‘নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলে তাকে ওমান পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়। এরপর ওমান ডিপোরটেশন ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় সন্তানের জন্ম হয়।’
এর আগে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ওমান থেকে হবিগঞ্জের গুলজাহান বেগম তিন মাস বয়সী সন্তানসহ দেশে ফিরতে বাধ্য হন।
এ ধরনের ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতির শিকার নারী ও তাদের সন্তানরা সমাজ ও পরিবারে অবহেলিত হয়ে বেড়ে উঠবে। এমন ১২ সন্তানকে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে, এখনও করা হচ্ছে বলে জানান শরিফুল হাসান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘সৌদি আরবে যে নারীরা যান, তারা গৃহকর্মী হিসেবে বাসাবাড়িতে কাজ করেন৷ এই ক্ষেত্রটিই সমস্যার, কারণ, সেখানে যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে তা গৃহকর্তার দ্বারাই হন৷ সৌদি আইনে গৃহকর্তাকে বিশেষ অধিকার দেয়া আছে৷ সেখানে বিদেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীদের প্রটেকশনের কোনো আইন নেই৷’
তারা জানান, ‘জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই৷ পাঠানো হয় সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে৷ স্মারকেও দুর্বলতা আছে৷ যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও এটা আরেকটু শক্ত করা যেতো যে ওখানে গিয়ে কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে যেন ওখানকার আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেটাও করা হয়নি৷ আর নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো নারী যখন এমন অবস্থায় উপনীত হয়, ওই দেশ ছেড়ে আসতে পারলেই সে তখন বেঁচে যান৷
তারা বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে সৌদি সমাজের একটা বড় অংশ এখনো মধ্যযুগের ধ্যানধারণা নিয়ে বাস করছে। যা কিছু আমার, তার ওপর আমার অধিকার নিরঙ্কুশ— এই প্রাচীন ধারণা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারেনি। একবিংশ শতাব্দীর বেতনভুক গৃহকর্মী আর মধ্যযুগের ক্রীতদাসের মধ্যে তফাত বুঝতে অনেকে অক্ষম। সৌদি রাষ্ট্র তাকে সেটা বোঝাতে খুব তৎপর, অবস্থাদৃষ্টে তা–ও মনে হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের ৩ লাখ নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে কাজ করছেন, এটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আরও কর্মী যাতে যেতে পারেন, তা–ও আমাদের দেখতে হবে। তবে যে নারী কর্মী সৌদি আরবে যাচ্ছেন, তার শারীরিক, মানসিক ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাঠানোর আগে ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে তাকে, পাঠানোর পর তার নিরাপত্তার জন্য রক্ষাকবচ আরও দৃঢ় করতে হবে। এসব করতে না পারলে সৌদি আরবে নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ