সাম্প্রতিক সময়টাতে মহামারি করোনার জন্য উর্বর স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে করোনা তার বিষদাঁতে মরণ কামড় দিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত বিপর্যস্ত, ভারতের প্রতিবেশি দেশ নেপালও নাজেহাল, আর বাংলাদেশও করোনার ভয়ংকর ভারতীয় ধরনের জন্য হটস্পট বলেও গবেষকরা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। করোনার এই প্রলয়ংকারী ঝড়ের মাঝে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্ষা।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিবৃষ্টি, সেই সঙ্গে আরও বেশি বিপদ নিয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে চলেছে দক্ষিণ এশিয়ার বর্ষাকাল। সায়েন্স অ্যাডভান্সেস সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে এমন হুঁশিয়ারি।
এক গবেষণায় দেখেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে ভারতে বর্ষা মৌসুমে আরও বেশি বৃষ্টিপাত হবে এবং তা আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
জলবায়ু পরিবর্তন যে বর্ষা মৌসুমকে বিঘ্নিত করে থাকে, তা আগে থেকেই জানেন গবেষকেরা। আগে কম্পিউটার মডেলভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও উষ্ণ আবহাওয়ায় আর্দ্রতা বাড়ার কারণে বর্ষায় অতিবৃষ্টি, অপ্রত্যাশিত ও চরম বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটতে পারে।
গত শুক্রবার(৪ জুন) সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদন বিজ্ঞানীদের ওই ধারণার পক্ষেই নতুন প্রমাণ হাজির করেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। গত ১০ লাখ বছরে জলবায়ু কীভাবে বদলেছে, সেই তথ্য বিশ্নেষণ করে বিজ্ঞানীরা এ গবেষণায় ধারণা দিতে চেয়েছেন যে, কেমন হতে পারে আগামী দিনের বর্ষাকাল।
ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মোটামুটি জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বর্ষাকাল ধরা হয়। এ সময় মৌসুমি বায়ু যে বিপুল বৃষ্টি নিয়ে আসে, তা এ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই বৃষ্টি পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। সময়মত বৃষ্টি যেমন ফসল উৎপাদন বাড়ায়, তেমনি আবার অসময়ের অতিবর্ষণ ফসল ধ্বংসও করে। অতিবৃষ্টি নিয়ে আসে বন্যা, কেড়ে নেয় প্রাণ, ধ্বংস করে লোকালয়, ছড়িয়ে দেয় দূষণ।
নতুন এই গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বর্ষার এই মেজাজ বদলে পুরো অঞ্চলের চেহারা আর ইতিহাসই বদলে যেতে পারে।
গবেষকেরা বৃষ্টিপাতের তথ্য বের করতে কাদা নিয়ে গবেষণা করেন। তারা বঙ্গোপসাগরে খনন করে কোরের নমুনা সংগ্রহ করেন। অতিবর্ষার মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে বেশি পরিমাণ স্বাদু পানি প্রবেশ করে। এতে পৃষ্ঠের লবণাক্ততা কমে যায়। সমুদ্রতলপৃষ্ঠে বসবাসকারী প্লাঙ্কটন মারা যায় এবং পলির স্তরে স্তরে ডুবে যায়। গবেষকেরা ওই নমুনা থেকে প্লাঙ্কটনের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করেন। সেখান থেকে অক্সিজেন আইসোটোপ বিবেচনায় নিয়ে পানির লবণাক্ততা বের করেন।
তাতে দেখা যায়, অতিবৃষ্টি ও কম লবণাক্ততার বিষয়টি সৃষ্টি হয়েছিল বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই–অক্সাইডের উচ্চতর ঘনত্বের পর।
এ কাজে পৃষ্ঠ থেকে ২০০ মিটার গভীর পর্যন্ত মাটির নমুনা নেওয়া হয়েছে, যাতে প্রতি বর্ষায় জমা নতুন স্তরগুলো থেকে বৃষ্টিপাত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
যে বছর বৃষ্টি বেশি হয়, সাগরে স্বাদু পানির যোগান বাড়ে, উপরিভাগের লবণাক্ততা কমে আসে। তাতে সাগরের উপরিতলে থাকা অনেক ক্ষুদ্র ও আণুবীক্ষণিক জীবের মৃত্যু হয়, সেসব দেহাবশেষ জমা হয় মাটির স্তরের সঙ্গে। এভাবে প্রতিবছর পরতের পর পরত জমে সাগরতলের ভূস্তরে গ্রন্থিত হয় ইতিহাস।
মাটির নমুনা সংগ্রহ করার পর বিজ্ঞানীরা সেসব মৃত প্লাঙ্কটনের ফসিল পরীক্ষা করে অক্সিজেন আইসোটোপ বিশ্লেষণ করেছেন। তাতে ওই সময়ের পানির লবণাক্ততার পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।
দেখা গেছে, বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি, বরফ স্তর কমে আসার পর মৌসুমি বায়ুতে আর্দ্রতা বাড়তে শুরু করে এবং তারপর আসে সেই অতি বৃষ্টি আর সাগরের পানিতে লবণাক্ততা কমে আসার পর্ব।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের কর্মকাণ্ড বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ যেভাবে বাড়িয়ে চলেছে, তাতে মৌসুমি বায়ুতে সেরকম আরেকটি পরিবর্তন আসন্ন।
এ গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রাউন ইউনিভার্সিটির আর্থ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস এর অধ্যাপক স্টিভেন ক্লেমেন্স।
তিনি বলেন, ‘গত ১০ লাখ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষা মৌসেুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যায়। ফলে জলবায়ু মডেলগুলোর যে পূর্বাভাস আমরা এতদিন পেয়ে আসছি, তার সঙ্গে লাখো বছরের প্রবণতা দারুণভাবে মিলে যাচ্ছে’।
জার্মানির পোস্টড্যাম ইনস্টিটিউটের ক্লাইমেট ডাইনামিকসের অধ্যাপক অ্যান্ডার্স লিভারম্যান নতুন এ গবেষণায় যুক্ত না থাকলেও মৌসুমি বায়ু নিয়ে বিভিন্ন মডেল ধরে গবেষণা করেছেন এর আগে।
লিভারম্যান বলছেন, জলবায়ু মডেল ধরে তাদের পূর্বাভাসকেন্দ্রিক গবেষণার সঙ্গে নতুন এ গবেষণার ফলাফল মিলে যাওয়ায় তিনি স্বস্ত্বি পাচ্ছেন, কারণ তাদের চেষ্টা ভুল পথে যায়নি।
তিনি বলেন, ‘এবারের গবেষণায় যে বিপুল তথ্য এসেছে, সেটা অসাধারণ। পৃথিবীর ইতিহাসের লাখ লাখ বছরের কথা বলছে এসব তথ্য। প্রকৃতির যে নিয়ম আমরা প্রতিদিন দেখছি, তা ওই ভূস্তরে স্পষ্ট ছাপ রেখে যাচ্ছে’।
আর এই ঘটনাপ্রবাহ যে ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দাদের জন্য দুর্দিন নিয়ে আসছে, সে বিষয়েও নিশ্চিত এই গবেষক।
তিনি বলছেন, সাম্প্রতিক বর্ষ মৌসুমগুলোতে বৃষ্টির আর ক্ষতির পরিমাণ এমনিতেই বেড়ে গেছে। কিন্তু ভবিষ্যতের যে ঝুঁকি তারা দেখতে পাচ্ছেন, তা হবে বিপর্যয়কর। তাছাড়া ঋতু বৈচিত্র্য যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে, তাতেও প্রাণ ও প্রতিবেশের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক স্টিভেন ক্লেমেন্স এবং তার সহযোগী গবেষকরা সাগরতলের মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে দুই মাসের একটি অভিযানে অংশ নেন। এ কাজে তারা ব্যবহার করেন তেলকূপ খননের কাজে ব্যবহৃত জাহাজ জয়েডস রেজুলেশন, যেটি গবেষণার জন্য বদলে নেওয়া হয়েছে।
২০১৪ সালের নভেম্বরে ১০০ ক্রু এবং ৩০ জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে অভিযান শুরু করেছিল জাহাজটি। সাগর তলের মাটি খুঁড়ে সে সময় সংগ্রহ করা নমুনা বিশ্লেষণ করেই বিপুল এই তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছেন ক্লেমেন্সদের দলটি।
তিনি বলেন, ‘বহু বছর ধরে আমরা এর পেছনে লেগে আছি। ভালো লাগছে, এসব তথ্য এখন আমরা প্রকাশ করতে পারছি’।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশবিজ্ঞানীরাও বলছেন, এদেশেও বর্ষাকাল বদলে যাচ্ছে। আগে বর্ষাকাল একটা সাইকেল বা চক্র মেনে চলত। এখন সেটা দেখা যাচ্ছে না। তবে তারা বলেছেন, এদেশে বৃষ্টিপাত বাড়লে তাতে লাভই বেশি হবে। অনেক বিপন্ন নদী নাব্য ফিরে পাবে। আবার বৃষ্টির ফলে স্বাদু পানির সরবরাহ বাড়লে লবণের পরিমাণ কমে যাবে।
এই গবেষণা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, কখনও হঠাৎ ভারি বর্ষণ আবার কখনও প্রকৃতি উষ্ণ হয়ে উঠছে। এখন প্রতিদিন যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, এটা কাছাকাছি অন্যান্য কয়েক বছরে দেখা যায়নি। গত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া স্বাভাবিক আচরণ করছে না। এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশেও বর্ষা তার রূপ বদলাতে পারে। অতিবর্ষণ হতে পারে। এতে বিপদ বাড়তে পারে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ওই দৈনিককে বলেন, বর্তমানকে জানতে হলে অতীতকে জানতে হবে। আমাদের ছয়টি ঋতু ছিল। সেখান থেকে চারটি ঋতুতে চলে আসছে। বৃষ্টিপাতের মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে দু’বার বৃষ্টি হয়েছে, যা অস্বাভাবিক। যখন থেকে বর্ষা শুরু হওয়ার কথা তার পরে শুরু হচ্ছে। আবার যখন শেষ হওয়ার কথা তার অনেক পরে শেষ হচ্ছে। অল্প সময়ে খুব বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। আগে পুরো চার মাস ধরে বৃষ্টি হতো। একটা সাইকেল ছিল। এখন বৃষ্টিপাতের কোনো সাইকেল নেই।
তিনি বলেন, বৃষ্টিপাতের এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারণে কিছু বিপদ হচ্ছে। ভারতবর্ষের বর্ষা নিয়ে গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশও বর্ষা যদি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, তাহলে ক্ষতির চেয়ে বাংলাদেশ লাভই বেশি হবে। কারণ বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নাব্য হারানো নদীগুলো জীবন ফিরে পাবে। খনন করে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা পৃথিবীর কোথাও নেই। উপকূলে খরাসহ নানা কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টিতে স্বাদু পানি বাড়লে লবনের পরিমাণ কমে যাবে। নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও পুনরুদ্ধার হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ভূগর্ভের পানির চাহিদা কমানো যাবে। সরকারকে এখন থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ