গত ১ ফেব্রুয়ারি অং সান সু চির নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে আছে মিয়ানমার। বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়নে নিহত হয়েছে অন্তত ৮৪৫ জন। সম্প্রতি রাজপথে বিক্ষোভ শিথিল হয়ে আসলেও সশস্ত্র প্রতিরোধ বাড়ছে।
মিয়ানমারের দক্ষিণপূর্বের কারেন রাজ্যে একটি সশস্ত্রগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ডেমোসো নামক অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর সাথে কারেন গোষ্ঠীর সংঘর্ষ হয়। এতে সাধারণ মানুষেরও নির্বিচারে প্রাণহানি ঘটে। সংঘর্ষে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলার পর গ্রামবাসীরা ঘরবাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেছে। খবর আল-জাজিরার
ওই গ্রামটির নাম মি মেহে’র। বর্তমানে সেখানে কেউ নেই! মি মেহে’র গ্রামটি শান রাজ্যের কাছাকাছি। যেখানে কিছুদিন আগেই সেখানকার মানুষজন পালাতে বাধ্য হয়েছিল। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ডেমোসোর ১ লাখ মানুষের মধ্যে ৮৫ হাজার মানুষ ১০ দিনের মধ্যে পালিয়ে যায়।
ওই গ্রামের একজন বাসিন্দা মি মেহ। আল জাজিরা তার সাথে আলাপ করে। এই প্রতিবেদনটির জন্য আল-জাজিরা মি মেহের ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে। যাতে করে প্রতিবেদনের জন্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো কয়েকজনের সাক্ষাতকার নিতে পারে। কারণ, সামরিক বাহিনীর সমালোচনা বা বিরোধিতা যারা করে তাদের গ্রেপ্তার বা মেরে ফেলা হয়।
মি মেহ এবং গ্রামের সবাই মিলে শুধু একটি কাপড় দিয়েই তারা শিবির নির্মাণ করে। যার শুধু পেছনের অংশ ঢাকা আর খুব সামান্য পরিমানে মাটির অংশ ঢেকে রাখে। ২৭ মে আল-জাজিরা যখন মি’র সঙ্গে কথা বলছিলো তখন তিনি ভারী বৃষ্টির মধ্যেই খাবার ও পানির খোঁজে যাচ্ছিলেন। বৃষ্টিতে তার জামা কাপড় ভিজে গিয়েছিলো এবং এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তিনি গোসল করেননি।
তবে, মি’র জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ছিলো তার নিরাপত্তা। প্রায়ই, তাদের মাথার উপর দিয়ে জেট বিমান উড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে অনেক নারী ও শিশু রয়েছে…আমি সত্যিই ভীত কারণ সামরিক মানুষদের কোন মানবিকতা নেই।তারা যেকোন সময় আমাদের হত্যা করতে পারে।’
কারেন রাজ্যের এক স্থানীয় নেতা বলেন, ‘বার্মা সরকার নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে। সেখানে জনগণের নিজেকে নিজেই রক্ষা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।’
তিনি আরও জানান, বার্মা সরকারের মতো তাদের ক্ষমতা নেই, অস্ত্র নেই। তবুও তারা এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য তাদের যথেষ্ঠ সদিচ্ছা ও মনোবল রয়েছে।
এর আগে গত শনিবার মিয়ানমারে এইয়ারওয়াদি নদী এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন সাধারণ গ্রামবাসী নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনী অস্ত্র উদ্ধারের নামে অভিযান চালালে গ্রামবাসী তীরধনুক ও গুলতি নিয়ে প্রতিরোধ শুরু করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় দুই মাসের মধ্যে এটাই দেশটিতে একদিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী ঘটনা।
শনিবার ভোরে মিয়ানমারের মূল শহর ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দূরে হ্লাসোয়ে গ্রামে সেনাবাহিনী ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। স্থানীয় চারটি সংবাদমাধ্যম ও একজন স্থানীয় বাসিন্দার বরাতে সংঘর্ষের খবর দিয়েছে রয়টার্স। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা বলেন, গ্রামবাসীর কাছে শুধু গুলতি আর তীর-ধনুক ছিলো, সেই কারণে তারাই বেশি হতাহত হয়েছেন।
খিট থিট মিডিয়া এবং ডেল্টা নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন বেসামরিক নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, সেনাবাহিনী অস্ত্র উদ্ধারের নামে অভিযান শুরু করলে প্রতিরোধ করে গ্রামবাসী।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অং সান সু চি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। দেশটির সাধারণ জনগণ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। অভ্যুত্থানের চার মাসেও দেশটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি জান্তা।
মিয়ানমারে আয়েইরাবতি অঞ্চল চাউল উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলটিতে মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু বামার জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু কারেন জনগোষ্ঠীর বহু লোক বাস করেন। দেশটির সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই এই বামার জনগোষ্ঠীর লোক।
স্থানীয় অধিকার গোষ্ঠী অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারস (এপিপিপি) জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে সেনাঅভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভে মিয়ানমারে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮৪৫ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে সাংবাদিক, লেখকসহ আটক আছেন চার হাজারেরও বেশি মানুষ।
আগামী সোমবার থেকে সু চির বিচার শুরু
আগামী ১৪ জুন থেকে মিয়ানমারের আদালতে দেশটির কারাঅন্তরীণ গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চির বিচার শুরু হচ্ছে। সু চির আইনজীবী মিন মিন সোয়ে ফ্রান্সের বার্তাসংস্থা এএফপিকে সোমবার এ তথ্য জানিয়েছেন।
মিয়ানামারের রাজধানী নেইপিদোতে গৃহবন্দি সু চির সঙ্গে এ দিন সাক্ষাৎ করেছেন মিন মিন সোয়ে। সাক্ষাৎ শেষে সু চির বিচার শুরুর তারিখ জানিয়ে এএফপিকে সোয়ে বলেন, ‘আশা করছি ওই দিনই (১৪ জুন) মামলার বাদিপক্ষ তাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ ও সাক্ষীদের হাজির করবে।’
অবৈধ ওয়াকি টকি রাখা, ঘুষ গ্রহণ, রাষ্ট্রের গোপন তথ্য পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে সু চির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা। সেগুলোর মধ্যে কোনটির বিচারকাজ শুরু হবে আগামী সপ্তাহে, সে বিষয়ে কিছু বলেননি মিন মিন সোয়ে।
২০২০ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের জাতীয় ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। মিয়ানমারের সেনা প্রধান মিন অং হ্লেইং এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন।
ক্ষমতা দখলের পরপরই বন্দি করা হয় অং সান সুচিসহ তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)-এর বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের। সু চির বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার।
এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রের গোপন তথ্য পাচারের অভিযোগে করা মামলাটি বেশ গুরুতর বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী, এই মামলায় অপরাধী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের সাজা হতে পারে সু চির।
জান্তা সরকার ইতোমধ্যে সু চির দল এনএলডি বিলুপ্ত করার হুমকিও দিয়েছে। জান্তা সমর্থিত নির্বাচন কমিশনের অভিযোগ, ২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডি জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ