গোটা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছে সম্প্রতি হামাস-ইসরায়েলের যুদ্ধ। যুদ্ধে ইসরায়েল পরাজিত না হলেও, হামাসকে জয়ী বলা যেতেই পারে। যুদ্ধ বিরতিতে ইসরায়েলকে বাধ্য করার পাশাপাশি হামাসের এই প্রতিরোধে গোটা বিশ্বই যেন নতুন এক সক্ষমতার ইঙ্গিত পেয়েছে। ইয়ুরোপসহ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ইসরায়েলের অনেক মিত্রই। সংঘবদ্ধ হচ্ছে আরবেরা। যুদ্ধ বিরতির জন্য ইসরায়েলের আর্জির কথা সামনে আসায় নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে চাঞ্চল্য।
হামাসের সক্ষমতা নিয়ে বাড়ছে কৌতূহল। এমনকি ইসরায়েল হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কও ধ্বংস করতে পারেনি। উপরন্তু আলজাজিরার নারী সাংবাদিককে পিটিয়ে গ্রেফতার করে হয়েছে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত। তাদের মাথার উপর থেকে ছায়া সরিয়ে নিচ্ছে অনেকেই। সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের সাথে ঐক্য প্রকাশ করতে ইসরায়েলি জাহাজের পণ্য খালাসে অস্বীকৃতি জানিয়েছে খোদ মার্কিন ওকল্যান্ড বন্দরের শ্রমিকেরা।
ইসরায়েলি জাহাজের পণ্য খালাসে অস্বীকৃতি
ইসরায়েলের একটি কার্গো জাহাজের মালামাল খালাস করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন আমেরিকার ওকল্যান্ড বন্দরের শ্রমিকরা। ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ইহুদিবাদীদেরকে বয়কটের যে ডাক দেয়া হয়েছে, তাতে সাড়া দিয়ে ওকল্যান্ড বন্দর শ্রমিকরা ওই পদক্ষেপ নেন। খবর এবিসি নিউজের।
ফিলিস্তিনপন্থী আমেরিকার বিক্ষোভকারীরা অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ওপর ইহুদিবাদী সেনাদের বর্বর আগ্রাসনের প্রতিবাদে ওকল্যান্ড বন্দরে ইসরায়েলি জাহাজ নোঙ্গর ও খালাস করা নিষিদ্ধ করেন। ফলে জাহাজটি ওকল্যান্ড বন্দর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
এ সময় বন্দর শ্রমিকরা এবং অন্য বিক্ষোভকারীরা মিলে সেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ আয়োজনকারীদের অন্যতম ওয়াসিম হেজ সাংবাদিকদের বলেন, আজ আমরা ওকল্যান্ড শহরের পক্ষ থেকে একথা প্রমাণ করে দিলাম যে, আমরা বর্ণবাদী ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য করব না।
যুদ্ধবিরতির জন্য ধর্ণা দিয়েছিল ইসরায়েল
ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস এবং ইসলামি জিহাদ আন্দোলনের ভয়াবহ রকেট হামলার মুখে যুদ্ধবিরতির জন্য আমেরিকার কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন ইহুদিবাদী ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সূত্র ইসরায়েলি পত্রিকা ইয়েদিয়োথ অহরোনথ।
পত্রিকাটি বলেছে, ১১ দিনের যুদ্ধে হামাসের রকেট হামলার মুখে নিরুপায় হয়ে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে আমেরিকার মধ্যস্থতা কামনা করে। যুদ্ধের বিষয়ে যা ধারনা করা হয় এক্ষেত্রে বাস্তবতা ছিল তার বিপরীতে। অর্থাৎ ইসরায়েল ধারনাই করতে পারেনি এবারের যুদ্ধটা হামাস ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নিয়ে যাবে।
পত্রিকাটির তথ্য অনুসারে, ইহুদিবাদী ইসরায়েল জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার যোগাযোগ করেছে যাতে আমেরিকা মিশর এবং আরও কয়েকটি দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করে। তবে জো বাইডেন প্রশাসন এ ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। ফলে মিশরকে ইসরায়েল বার্তা পাঠায় এবং মার্কিন অনুমোদন নিয়ে মিশর যেন হস্তক্ষেপ করে।
এদিকে, হামাসের গাজা উপত্যকার প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার বলেছেন, ইহুদিবাদী ইসরায়েলের সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধ হলে মধ্যপ্রাচ্যের অবয়ব পাল্টে যাবে। সম্প্রতি যুদ্ধের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে, আল-আকসা মসজিদের একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী রয়েছে এবং পবিত্র এই মসজিদ রক্ষা করা হচ্ছে কৌশলগত লক্ষ্য।
হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংসে ইসরায়েলের ব্যর্থতা
সাম্প্রতিক আগ্রাসনে ইসরায়েল হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার জোর প্রচেষ্টা চালালেও তা ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজার হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ১১ দিনের ওই তাণ্ডবে ইসরায়েল তাদের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের তিন শতাংশেরও কম ধ্বংস করতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
শনিবার ইসরায়েল অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে পেশাজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা গাজায় হামাসের যুগান্তকারী সাফল্যের ইঙ্গিত দেন।
সিনওয়ার আরও বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে আরব বিশ্বের দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা এবং ফিলিস্তিনিদের বিভেদের কারণেই দখলদার বাহিনী গাজায় হামলা চালাতে উৎসাহিত হচ্ছে।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি কমবে প্রত্যাশা করে হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার বলেন, আন্তর্জাতিক সহায়তায় গাজা পুনঃনির্মাণ হবে এবং অর্থনীতি সচল বলে।
ইসরায়েলের বিমান হামলায় ধ্বংস হওয়া অঞ্চল পুনঃনির্মাণে হামাস বাধা দেবে না অঙ্গীকার করে তিনি বলেন, পুনঃনির্মাণের অর্থ হামাসের ফান্ডের জন্য ব্যবহৃত হবে না।
সাংবাদিককে পিটিয়ে গ্রেফতার
বিশ্ববাসীর কাছে ইসরায়েলের বর্বরতার খবর তুলে ধরায় গণমাধ্যমের ওপর বেজায় চটেছে ইহুদিবাদী দেশটি। গতকাল শনিবার অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে বিক্ষোভের সংবাদ প্রচারকালে ইসরায়েলি পুলিশ আলজাজিরার সাংবাদিক জিভারা বুদেইরিকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে তার ক্যামেরা ভাঙে এবং মারধরের পর গ্রেফতার করেছে। খবর আল জাজিরা ও আরব নিউজের।
কয়েক ঘণ্টা হেফাজতে রাখার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এ সময় আলজাজিরার ক্যামেরাম্যান নাবিল মাজাবির সরঞ্জামাদিও ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক কড়া নিন্দা জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম সমর্থক ও পর্যবেক্ষক সংগঠনগুলো।
শনিবার বিকেলে মুক্তি পাওয়ার কিছুক্ষণ পর বুদেইরি আলজাজিরাকে বলেন, তারা চতুর্দিক থেকে ছুটে আসলো, আমি জানি না কেন। তারা আমাকে লাথি মেরে দেয়ালের ওপর ফেলে দেয়। আমাকে গাড়ির ভেতরও প্রচণ্ড জোরে লাথি মারে। এ সময় তারা আমাকে চতুর্দিক থেকে লাথি মারছিল।
এর আগে গাজায় হামলার সময় সেখানে আলজাজিরা ও অ্যাসোসিয়েট প্রেস-এপির ব্যুরো অফিস বিমান হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় ইসরায়েল। বহুতল ওই ভবনে আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের কার্যালয় ছিল।
প্রসঙ্গত, গত মাসে ইসরায়েল শেখ জারাহ বসতি থেকে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জোরপূর্বক উচ্ছেদের চেষ্টা চালায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামাস, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। টানা ১১ দিন যুদ্ধের পর মিশরের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। সংঘাতে ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই নিজেদের বিজয়ী দাবি করেন।
ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং গোলার আঘাতে ২৮০ জনের অধিক ফিলিস্তিনি নিহতসহ প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের রকেট হামলায় ইসরায়েলের দুইজন শিশুসহ ১২ জন নিহত হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫০৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ