রোহিঙ্গাদের নিয়ে ক্রমশ জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। মিয়ানমার সরকারের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেই স্থায়ীভাবে বসবাসের দিকে ঝুঁকছে। যদিও সম্প্রতি জান্তা সরকারের রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে অনাগ্রহ প্রকাশের পর, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে নাগিরকত্ব স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিয়ানমারের ছায়া সরকার। এদিকে, মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) ধীরে ধীরে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে উঠছে। ক্রমেই জোরালো হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা দখলকারী সেনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি মিয়ানমারের ছায়া সরকারের
জান্তা সরকার উৎখাত করে ক্ষমতায় ফিরতে বৃহস্পতিবার পাঁচটি নীতিকৌশল প্রকাশ করেছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ঐক্য সরকার। এর মধ্যে অন্যতম হলো, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যাক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে নাগিরকত্ব স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত নীতিকৌশলে ১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ওই আইনের মাধ্যমে দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্বের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে।
এনইউজি সরকার বলছে, আইনটি সংশোধন করে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে জন্ম নেয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের সন্তানকে পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। বিবৃতিতে রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের নাগরিকদের এনইউজি সরকারের সঙ্গে যুক্ত হতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
বলা হয়েছে, ‘অবৈধ এক নায়কতন্ত্র সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সেই সঙ্গে আমাদের সঙ্গে অথবা অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলান।’
এনইউজি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর সহিংসতা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গত কয়েক দশক ধরে রাখাইনে চলা সহিংসতায় লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হওয়ার বিষয়টি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে জাতীয় ঐক্য সরকার।
সম্প্রতি দেশটির রাজনীতিবিদসহ বেসামরিক নাগরিকদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐক্য সরকার এনইউজি। এর মধ্যে সু চির রাজনৈতিক দল এনএলডির সদস্যরাও রয়েছেন। তারা মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে, নিজেদের মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে দাবি করছে। একই সঙ্গে বিশ্বের দরবারে সমর্থন পাওয়ারও চেষ্টা করছে তারা।
তবে একে সন্ত্রাসী দল অ্যাখা দিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। এমনকি এই দলের সঙ্গে কেউ প্রকাশ্যে অথবা গোপনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। যদিও সামরিক সরকারের হুমকি উপেক্ষা করেই নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এনইউজি সরকার।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে সাড়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয়ে রয়েছে। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ মিয়ানমার সরকারকে চাপ দিলেও এ নিয়ে গড়িমসি করে আসছে দেশটি।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহ নেই জান্তা সরকারের
সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রথম দেয়া সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছে চীনা ভাষার টেলিভিশন ফিনিক্স। গত সোমবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
মিন অং হ্লাইংকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রাখাইন রাজ্যে থেকে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ফেরার অনুমতি দেওয়া হবে কিনা। মিয়ানমারের জান্তা প্রধান বলেন, যদি তা মিয়ানমারের আইন অনুসারে না হয়, তাহলে এখানে বিবেচনারও কিছু কী আছে? আমি বিশ্বাস করি না, বিশ্বে এমন কোনও দেশ আছে যারা শরণার্থী গ্রহণে নিজেদের শরণার্থী আইনের ঊর্ধ্বে কিছু করবে।
রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আবেদনের কোনও কার্যকারিতা কি নেই জানতে চাইলে মিন অং হ্লাইং মাথা নাড়ান। ২০১৭ সালে সামরিক অভিযান থেকে বাঁচতে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়েছিলেন। তখন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন মিন অং হ্লাইং। সাক্ষাৎকারে তিনি আবারও দাবি করেছেন, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা কোনও জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়।
তার মতে, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার পরই রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পর আদমশুমারিতে বাঙালি, পাকিস্তানি, চিট্টাগং শব্দ নিবন্ধন করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা বলতে কোনও শব্দ ছিল না। তাই আমরা এটি কখনও মানিনি।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে মনে করে। এর মধ্য দিয়ে তারা বলতে চায় যে, মিয়ানমারে তারা বাংলাদেশ থেকে আসা বহিরাগত। যদিও অনেক রোহিঙ্গাই শত বছর ধরে সেখানে বসবাস করছিলেন।
রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থনের অভিযোগে ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত মিয়ানমারের নির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চিও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। সু চি ও দেশটির সেনাবাহিনী এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনসম্মত অভিযানের মুখে শরণার্থীরা বাংলাদেশে পালিয়েছে।
সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েক দিন পরেই মিন অং হ্লাইং দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। কিন্তু মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ ব্যস্ত থাকা জান্তা সরকারের আমলে এই প্রক্রিয়ায় কোনও অগ্রগতি হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে (এনএলডি) ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সামরিক বাহিনী। এনএলডির নেত্রী অং সান সু চি ও অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতার করে কারাবন্দি করে রেখেছে সামরিক জান্তা। অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গণতন্ত্র পুনর্বহাল ও সু চিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করছে জনতা। প্রথমদিকে সংযম দেখালেও ক্রমেই সহিংসপন্থায় বিক্ষোভ দমন করার চেষ্টা নিয়েছে সামরিক কর্তৃপক্ষ। বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির হুমকি দিয়েছে তারা। ইতোমধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ শতাধিক বেসামরিক নাগরিক।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪২০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ