পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হলে পরিবারে আকাশছোঁয়া আনন্দ৷ কন্যাসন্তান হলে সবার মুখ ব্যাজার৷ মেয়ে মানেই সংসারে বোঝা৷ এতোকিছুর মাঝে যখন মা পরপর কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তখন তার লাঞ্ছনার আর সীমা থাকে না। লাঞ্ছনার তীব্রতা বেড়ে গেলে মা নিজ কন্যা সন্তানকে মেরে ফেলারও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। অনেকে মেরেও ফেলেন।
তেমনি এক ঘটনা ঘটেছে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামে।
পুত্র সন্তানের আশায় পরপর তিন সন্তান জন্ম দেওয়ার পর চতুর্থবারও যখন মা কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তখন লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে স্বামীর ভয়ে নিজের ৮দিনের সন্তানকেও গলাটিপে মেরে ফেলেন এবং কন্যার মৃত লাশ ফেলে দেন পুকুরে।
আজ বুধবার (০২ জুন) ভোরে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় মা শ্যামলী ঘোষকে (৩৫) আটক করলেও বাবা পলাতক রয়েছেন।
আটক শ্যামলী ঘোষ খলিলনগর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের মানিক ঘোষের স্ত্রী। পরপর ৩টি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহনের পর চতুর্থ সন্তানও কন্যা হওয়ায় স্বামী মানিক ঘোষের নির্যাতন সইতে না পেরে নির্মম এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে ঘাতক মা দাবী করেছেন। পৈশাচিক এই ঘটনার পর থেকে গোটা এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পড়ে।
তালার রায়পুর গ্রামের রণজিৎ ঘোষ জানান, তার চাচাতো ভাই মানিক ঘোষের প্রথম পুত্র সন্তান অঙ্কুশ পানিতে ডুবে মারা যায়। এরপর মানিক ঘোষ-শ্যামলী ঘোষ দম্পতির ঘরে পরপর ৩টি কন্যা সন্তান হয়। ১টি পুত্র সন্তানের আশায় তারা আবারও সন্তান নেন। কিন্তু গত ৮দিন আগে নিজ বাড়িতে বৌদি শ্যামলী ঘোষের আবারও কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হয়।
তিনি জানান, গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বৌদির ঘরে ৮দিন বয়সী চতুর্থ কন্যাকে দেখতে না পেয়ে এদিন বিকালে তার কাছে সন্তানের কথা জিজ্ঞাসা করলে সে উদ্ভট কথা বলতে থাকে। একপর্যায়ে ওই কন্যাকে বাড়ির পাশে পুকুরে ফেলে দেবার কথা বলে। কিন্তু পুকুরে লাশ বা ওই মেয়েকে না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নেয়া হয়। রাত ১০টার দিকে বৌদি শ্যামলীকে আবারও জিজ্ঞাসা করলে সে একই কথা বলে। পরে গ্রামের লোকজন নিয়ে পুকুরে আবারও তল্লাশি করে পানিতে শিশুটির লাশ ভাসমান দেখে পুলিশে খবর দেয়া হয়।
তালা থানার ওসি মো. মেহেদী রাসেল বলেন, খবর পেয়ে রাত ৩টার দিকে পুকুর থেকে শিশু কন্যার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে ঘটনায় জড়িত থাকায় শিশুর মা শ্যামলী ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার (২ জুন) সকালে শিশুর মৃতদেহ সাতক্ষীরা মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করা হয়। এঘটনায় মানিক ঘোষের চাচাতো ভাই রণজিৎ ঘোষ বাদী হয়ে (বুধবার) তালা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
খলিলনগর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের বাসিন্দা আজমীর হোসেন জানান, ছেলে সন্তানের আশায় বাচ্চা নিয়ে মেয়ে হয়েছে। সে কারণে রাগ করে নবজাতকটিকে মেরে ফেলেছে।
খলিলনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান লিটু জানান, ঘটনাস্থলে চৌকিদারকে পাঠানো হয়েছিল। চৌকিদার ফিরে এসে জানিয়েছে শ্যামলী ঘোষের স্বামী মানিক ঘোষ বলেছেন, তিন মেয়ের পর আবার মেয়ে হয়েছে।এ মেয়েকে মেরে না ফেললে তোকে আমি বাড়িতে রাখব না। সে স্বামীর কথামতো নবজাতকটিকে মেরে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়। পরে রাতে পুলিশ নবজাতকটির মরদেহ উদ্ধার করে।
এব্যপারে অভিযুক্ত মা শ্যামলী ঘোষ বলেন, ৩টি কন্যার পর ৪র্থ সন্তান হিসেবে আবারও কন্যা সন্তান হওয়ায় স্বামী মানিক ঘোষ আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছিল। কন্যা সন্তান জন্মানোর দায়ে গত ১সপ্তাহ ধরে সে বাড়িতে আসা-যাওয়া এবং খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে আমাকে নানা গালিগালাজ ও হুমকি দিতো। একারণে বাধ্য হয়ে মেয়েকে পুকুরের পানিতে ফেলে দিই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কন্যা সন্তানের জন্মদানের জন্য দায়ী মা— এমন একটা মধ্যযুগীয় মানসিকতা গেড়ে বসেছে আমাদের সমাজে৷ গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, শহরাঞ্চলেও দেখা যাচ্ছে এমনটা৷ কন্যাসন্তানের জন্মের পর মাকে সহ্য করতে হচ্ছে গঞ্জনা, নির্যাতন৷
তারা বলেন, খবরের দিকে চোখ রাখলেই উঠে আসে একাধিক কন্যাসন্তানের জন্ম দেবার জন্য কীভাবে দোষী করা হচ্ছে মায়েদের৷ উঠতে বসতে নানা ধরনের কটুক্তি ও গঞ্জনা শুনতে হয় তাদেরই৷ কখনও কখনও তা মাত্রাও ছাড়িয়ে যায়৷ দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন ভোগ করতে হয় সংসারের এবং পরিবারের নিকটজনদের হাতে৷ কিন্তু কেন? কেন বৈজ্ঞানিক সত্য নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না? কারণ সেকেলে বিশ্বাস পুত্রসন্তান পরিবারের সম্পদ৷ বংশ রক্ষা হবে আর কন্যাসন্তান ট্যাবু৷ অনাকাঙ্খিত বোঝা, অপরের গচ্ছিত সম্পদ৷ যত তাড়াতাড়ি তাদের বিদায় করা যায়, ততই মঙ্গল৷ তাই বাল্যবিবাহ প্রথা আজও বন্ধ হয়নি দেশে৷ এই মধ্যযুগীয় মানসিকতার জন্য দায়ী আসলে অশিক্ষা বা কুশিক্ষা৷
তারা বলেন, পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হলে পরিবারে আকাশছোঁয়া আনন্দ৷ কন্যাসন্তান হলে সবার মুখ ব্যাজার৷ মেয়ে মানেই সংসারে বোঝা৷ আর ছেলে বংশরক্ষা করবে, রোজগার করবে, পরিবারে সবার অন্ন জোগাবে আর বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের দায়দায়িত্ব সামলাবে৷ এই বস্তাপচা মানসিকতা সমাজে আজও বদ্ধমূল৷
বলেন, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই আছে৷ তবে দেশে কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্যের একটা বড় কারণ সম্ভবত যৌতুক প্রথা৷ শহরে যৌতুক প্রথার প্রকৃতি কিছুটা বদলালেও সর্বত্র সেটা দেখা যায় না৷ যৌতুক প্রথা বেআইনি হলেও তা কার্যকর করতে সরকার গা করে না৷ চরম নির্যাতন বা বঁধূ হত্যা বা আত্মহত্যা পর্যন্ত না গড়ালে পুলিশ প্রশাসন নীরব দর্শকই থাকে৷ অথচ এতবড় একটা সামাজিক ব্যাধি নিয়ে বড় কোনো আন্দোলন তৈরি হচ্ছে না৷ রাজনৈতিক দলগুলি এই ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, পাছে ভোটব্যাংকে টান পড়ে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ