সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানা পুলিশ হেফাজতে আসামি মারধরের অভিযোগ উঠেছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক কুমার দাসের বিরুদ্ধে। আদালতে এবিষয়ে মামলা করেছেন নির্যাতিত আসামি বৃদ্ধ সাইফুদ্দিন প্রামাণিক (৭০)। একইসাথে ওসির বিরুদ্ধে আইনের দাপট দেখিয়ে মাস্তানি ও চাঁদাবাজি করেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
আজ বৃহস্পতিবার(২৮ মে) দুপুরে সিরাজগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালতে মামলাটি দায়ের করেন নির্যাতিত বৃদ্ধ সাইফুদ্দিন প্রামাণিক। আদালতের বিচারক আসাদুজ্জামান অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক কুমার দাস মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এটি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সঠিক তদন্তে তা প্রমাণিত হবে।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১০ মাস আগে উল্লাপাড়া উপজেলার বেতবাড়ী গ্রামে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিবাদীদের থানায় আসতে বলেন ওসি দীপক কুমার দাস। কিন্তু রাতে বিবাদীরা থানায় না আসার কারণে ক্ষিপ্ত হন ওসি। এর জের ধরে বিবাদীদের বাড়িতে প্রতিরাতে পুলিশি অভিযানের নামে পুরো গ্রাম তছনছ করাসহ হয়রানি করা হয়। এ হয়রানি থেকে বাঁচতে টাকার বাণিজ্য করতে থাকে পুলিশ। চাহিদা মতো টাকা পুলিশকে না দিলে বেতবাড়ী গ্রামে পুলিশি অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়িতে রাতে প্রবেশ করে ভাঙচুরসহ টাকা স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং একাধিক ব্যক্তিকে মামলা ছাড়াই গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে ব্যাপক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই নির্যাতনের বিষয় নিয়ে ভুক্তভোগী গ্রামবাসী সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের কাছে সব নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন। যা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশিত হয়। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ওসি দীপক কুমার দাস। এরপর থেকে সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া ব্যক্তিদের একে একে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে নতুন নতুন মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠাতে থাকেন ওসি।
গত ২৪ মে রাতে উল্লাপাড়া থানার চার-পাঁচজন পুলিশ সদস্য সাদা পোশাকে এসে বৃদ্ধ সাইফুদ্দিন প্রামাণিককে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। লোহার পাইপ দিয়ে সাইফুদ্দিনকে পিটিয়ে আহত করেন ওসি। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাতেই উল্লাপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এরপর ২৫ মে সাইফুদ্দিন প্রামাণিককে চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তার শারীরিক অবস্থা দেখে ও জবানবন্দি নিয়ে জামিন দেন এবং শারীরিক অবস্থা অবনতি দেখে চিকিৎসার জন্য সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করার আদেশ দেন।
অসুস্থ সাইফুদ্দিন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জ আমলী আদালতে মামলা করেন।
সাইফুদ্দিন প্রামানিক বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। কিন্তু আমি সাংবাদিকদের কাছে পুলিশি হয়রানির কথা বলেছি। এটাই আমার অপরাধ। এরই জের ধরে গত ২৪ মে রাতে উল্লাপাড়া থানার চার-পাঁচজন সাদা পোশাকের পুলিশ এসে আমাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। আমি শ্বাসকষ্টের রোগী। তারপরও দুই এসআই আমার হাত ধরে রাখে আর ওসি দীপক কুমার দাস আমাকে ব্যাপক মারধর করে। ওসিকে আমি বলি, ‘আমি আপনার বাবার বয়সী, আমাকে আর মারবেন না’। তিনি কোন কথা না শুনে এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে এমন করে মারধর করে যে, এতে আমি চরম অসুস্থ হয়ে পড়ি।
তার আরো অভিযোগ, পরে আমাকে ওই রাতেই উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে চিকিৎসা করায়। সেখানে ডাক্তাররা পর্যন্ত বলে, ‘কোনো মানুষ এই বৃদ্ধ মানুষকে এভাবে মারতে পারে? ওসি মানুষ না অন্য কিছু’। ওসির এই নির্যাতনে আমার দু’হাতের তালু, মাথায়, ডান হাতে, গলার পেছনে, তলপেটে, পিঠে ও দুই কানসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। এরপর ২৫ মে চাঁদাবাজি মামলা দিয়ে আমাকে সিরাজগঞ্জ আদালতে চালান করে দেয়। আদালত আমার অবস্থা দেখে ও আমার জবানবন্দি শুনে আমাকে জামিন দেন। সেই সঙ্গে আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে চিকিৎসার জন্য সিরাজগঞ্জ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করতে নির্দেশ দেন। আমি একটু সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে সার্টিফিকেট তুলে ২৭ মে বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার আমলি আদালতে হাজির হয়ে ওসির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করি।
তিনি আরো বলেন, আমি এই ওসির উপযুক্ত শাস্তি ও বিচার চাই।
এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোরশেদুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট নিখিল কুমার ঘোষ জানান, বাদীর দায়ের করা মামলাটি বৃহস্পতিবার বিজ্ঞ আমলি আদালতে উপস্থাপনের পর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আসাদুজ্জামান মামলাটি আমলে নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাদীর শারীরিক পরীক্ষার জন্য সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের রেজিস্টার্ড চিকিৎসককে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া বাদীর পক্ষের আইনজীবী পৃথক দরখাস্তে ঘটনার জুডিশিয়াল তদন্ত দাবি করায় তার বক্তব্য ও দাখিলকৃত কাগজ পর্যালোচনায় অভিযোগটি জুডিশিয়াল তদন্তের জন্য গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে আদালত নিজে তদন্ত করবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে উল্লাপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দীপক কুমার দাস বলেন, সাইফুদ্দিন প্রামানিকের বিরুদ্ধে অনেক আগের একটা মামলা ছিল। তাকে সেই মামলাতেই গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আমি কিংবা আমার কোন পুলিশ তাকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করেনি। আদালত তদন্ত করলে সঠিক ঘটনা বের হয়ে আসবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘‘যত গবেষণা বা জরিপ করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে পুলিশ সব সময় দুর্নীতিতে শীর্ষ পর্যায়ে আছে৷ এছাড়া মানুষকে হয়রানি করে, পকেটে মাদক- অস্ত্র দিয়ে পুলিশ ঘুষ আদায় করে বলে অভিযোগ আছে।
তারা বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচারিক প্রক্রিয়া এই ধরণের প্রতিষ্ঠান যখন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে তখন মানুষের বঞ্চনা বাড়ে এবং ন্যায় বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়ে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন একটি প্র্যাকটিসে (অভ্যাস) পরিণত হয়েছে। এখন থেকেই যদি এগুলো শক্ত হাতে মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে এসব বন্ধ করা খুব কঠিন হবে।
তারা বলেন, ‘অপরাধীরা অপরাধ করবেই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো অপরাধীর মতো আচরণ করতে পারে না। তাদের চাকরিতে প্রবেশের আগে যে প্রশিক্ষণ তা আরও যুগোপযোগী, মানবতা উপযোগী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ উপযোগী হওয়া উচিত।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ