বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় সংবাদপত্র দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা দায়ের করার পর তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।
এর আগে সোমবার (১৭মে) সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে প্রায় পাঁচ ঘন্টা আটকে রেখে শারীরিকভাবে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি সরকারের গোপন নথির ছবি তুলেছেন এবং সেগুলো সরিয়ে নিতে চেয়েছেন।
আইনে কী আছে?
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মূলত একটি ঔপনিবেশিক আইন। ব্রিটিশ শাসনামলে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। আঠারোশ নিরানব্বই সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত লর্ড কার্জন যখন ভারতবর্ষের ভাইসরয় ছিলেন তখন এই আইন প্রণয়ন করা হয়। বেশ কয়েক-দফা সংশোধিত হয়ে ১৯২৩ সালে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট জারি করা হয়।
এই আইনটি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে , এর দু’টি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে গুপ্তচরবৃত্তি এবং অপরটি হচ্ছে সরকারের গোপন নথি ফাঁস। তবে এই আইনের কোথাও উল্লেখ করা নেই যে সরকারি ‘গোপন’ নথি সংবাদপত্রে প্রকাশ করা যাবে না।
আইনে বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের পরিপন্থী কোন উদ্দেশ্য নিয়ে গুপ্তচর বৃত্তি করে তাহলে তার শাস্তি হবে। অর্থাৎ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কোন এলাকায় গমন করে, পরিদর্শন করে বা ভেতরে প্রবেশ করে তাহলে শাস্তি হবে।
বাংলাদেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, সচিবালয় কোন নিষিদ্ধ জায়গা নয়। সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের জন্য সরকার পরিচয়পত্র দিয়েছে এবং সরকার জানে যে সেখানে সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহের জন্য যাবে।
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী গোপন নথি বলতে বোঝানো হয়েছে অফিসিয়াল কোড, পাসওয়ার্ড, স্কেচ, নকশা, প্ল্যান, বিভিন্ন ধরণের নথি। শত্রুপক্ষের ব্যবহারের জন্য কোন ব্যক্তি যদি এগুলো সংগ্রহ বা রেকর্ড করে তাহলে এটি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। এই আইনের বিশেষ কিছু দিক হচ্ছে নিম্নরূপ। এই আইনে বলা হয়েছে তথ্য পাচার এবং তথ্য গ্রহণকারী – উভয়পক্ষ এর ফলে দণ্ডিত হতে পারেন।
এই আইনের অধীনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছর পর্যন্ত সাজা এবং সর্বনিম্ন তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে। প্রায় ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে যখন এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তখনকার সামাজিক বাস্তবতা এবং বর্তমান সামাজিক বাস্তবতা এক নয়।
বিতর্ক কোথায়
একজন সাংবাদিককে এই আইনে আসামি করে মামলা দেওয়ার পর দেশের স্বাধীন বা মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেক সংগঠন। বর্তমান আমলে আইনটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ব্রিটিশদের প্রশাসনে ভারতবর্ষের অনেকে কাজ করতো। তাদের প্রতি ব্রিটিশদের এক ধরণের অবিশ্বাস ছিল। তারা যাতে প্রশাসনের কোন গোপন নথি বা তথ্য পাচার বা প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রশাসনের গোপনীয়তা রক্ষা করা ছিল এই আইনের উদ্দেশ্য।
মনজিল মোরশেদ বলেন, গোপনভাবে তথ্য সংগ্রহ করা তো সাংবাদিকতার অধিকার। এটা ছাড়া তো সাংবাদিকতা চলে না। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন, সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। প্রকারান্তরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদকে জীবীত রাখে। এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কেউ যদি ব্রিটিশ আমলের এসব আইন দ্বারা নিগ্রহের শিকার হন, তবে সেটা সংবিধানের লঙ্ঘন।
জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন-২০১১ এর উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, এ আইনের সঙ্গে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ সরাসরি সাংঘর্ষিক। কারণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ আইনের ৪, ৫ ও ১৪ ধারায় তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। এমনকি তথ্য প্রকাশকারীকে পুরস্কৃত করার কথাও বলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম সাংঘর্ষিক বিদ্যমান দুটি আইনের মাঝে কোনটা প্রাধান্য পাবে। সে হিসাবে আমি বলব, সাংঘর্ষিক দুটি আইনের মধ্যে যে আইনটি নতুন অর্থাৎ সর্বশেষ নতুন আইনটিই প্রাধান্য পাবে, বলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যেতির্ময় বড়ুয়া এক ফেইসবুক পোস্টে এ আইনের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরে বলেছেন, ২০১১তে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন পাস হয়েছে, কিন্তু এর ব্যবহার নেই। সাংবাদিকরাও এই আইনের সুযোগ নেননি।
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’র সাথে এ আইনের সাংঘর্ষিক দিক তুলে ধরে তিনি তার পোস্টে লিখেছেন, দুটো আইন কিভাবে সাংঘর্ষিক হয়েও এখনও ব্যবহার হচ্ছে, সেটি দেখার বিষয়। রোজিনা ইসলাম যদি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য নিয়েও থাকেন, তা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়ার কথা এবং রোজিনাকে পুরস্কার দেওয়ার কথা ছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১২৩৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ