বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের ব্যবসায়িক দৌড়, সাধারণের আড়াই ফুট বাই ছ’ফুট খাটে শুয়ে দেখা স্বপ্নের চেয়ে অনেক বড়। সিমেন্ট থেকে শুরু করে রিয়েল এস্টেট, শপিং মল থেকে শুরু করে কনভেনশন সেন্টার, তরলিত পেট্রোলিয়াম গ্যাস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন পণ্য। এই সমস্ত কিছুই আনভীরকে প্রতিনিয়ত ক্ষমতার নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে।
চলতি বছর এপ্রিলের ২৭ তারিখ ঢাকার অভিজাত এলাকায় ২১ বছর বয়সী এক কলেজ ছাত্রী আত্মহত্যা করে। পুলিশের মতে, মেয়েটি ভাড়া নিয়ে একা থাকত একটি এ্যাপার্টমেন্টে এবং আনভীরের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটির আত্মহত্যার পরপরই তার বোন ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা’র অভিযোগ এনে আনভীরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। যার শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর। কিন্তু এরপরই হাওয়া বইতে থাকে ক্ষমতার অনুকূলে।
বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এই মামলার সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়কে গোপন করতে থাকে। আনভীরের নাম, তার পরিচয়, তার চেহারা প্রকাশে নানা তালবাহানা শুরু করে। যেখানে ভুক্তভোগী মেয়েটিকে এবং তার পরিবারকে গোপন রাখার নিয়ন থাকলেও, আনা হয় প্রকাশ্যে। বুলিংয়ের সুযোগ করে দে’য়া হয়। প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় তার চরিত্রকে।
ঘটনা ঘটার পরপর যেসব প্রতিবেদনে, ২১ বছর বয়সী ওই কলেজ ছাত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যবসায়ী কে এবং তার দৌরাত্ম্য কতদূর এবং মামলার অভিযোগের সত্যতার পেছনে থাকা সম্ভাব্য কারনের উল্লেখ ছিল, তা খুব চতুরতার সাথেই বদলে গেছে। এখন সেখানে পুঁজিপতি সায়েম সোবহান আনভীরকে নির্দোষ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রথম সারির টিভি চ্যানেল, ‘সময় টিভি’, আনভীরকে আলোচনার টেবিল থেকে সরাতে, ভিক্টিম মেয়েটিকে দোষী দেখাতে ছয়টি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রশ্ন তোলে, মেয়েটির প্রেমিকের সংখ্যা নিয়ে এবং কীভাবে এমন অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া ক’রে থাকত- তা নিয়ে।
বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’ ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের এই স্বর্ণযুগে গা ভাসিয়ে, তাদের একটি প্রতিবেদনে ভিক্টিমের ছবি ব্লার না ক’রে সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী আনভীরের ছবি ব্লার করে প্রচার করে। যদিও চ্যানেল আই এই ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং টেকনিক্যাল এররের জন্য এমন হয়েছে বলে জানায়।
কিন্তু যখন লোকাল মিডিয়া সেল্ফ সেনসরশীপে ব্যস্ত ছিল, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আনভীরের সাথে মেয়েটির ছবি, তাদের মধ্যকার একটি ফোনালাপ (যেখানে অভিযুক্ত আনভীর অকথ্য ভাষা ব্যবহার করেন) এবং মেয়েটির বোনের করা মামলার কপি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
এইসব ফেসবুক পোস্ট, আনসেনসর্ড এবং আনফিল্টার্ড, দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার আনভীরকে বাঁচানোর যে রণকৌশল ছিল, তাকে বালির বাঁধের মতো ভেঙে দেয়। এখন আর আনভীরের নাম গোপন রাখার কোন উপায়ই নেই মিডিয়াগুলোর। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মানুষ এই মামলার সাথে আনভীরের যুক্ত থাকার কথা জানে। তারা জানে আনভীর কে। তার ক্ষমতা কতটা। ফেসবুকে মানুষ যেভাবে এই মামলাটাকে ট্রিট করেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া বাধ্য হয়েছে একপ্রকার, স্পটলাইটটা ভিক্টিম মেয়েটির ওপর থেকে সরিয়ে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী এবং বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের উপর আনতে।
দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাপকহারে হ্রাস পাওয়া এই সময়টাতে ফেসবুকে প্রায়ই বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা ও মতামত দে’য়া হয়ে থাকে, যে ইস্যুগুলো কাভার করতে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াকে তোপের মুখে পড়তে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে ফেসবুকে বাংলাদেশি ইউজারের সংখ্যা সর্বোচ্চ। যখনই মেইনস্ট্রিম মিডিয়া কোন স্পর্শকাতর ঘটনায় কলাপস করে, তখন তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় ফেসবুক।
এমনকি তখনও, কিছু মিডিয়া হাউজ মামলাটির অভিযুক্ত হিসেবে আনভীরের নাম নিতে দ্বিধা করেছে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোর্ট মামলার ট্রায়াল ডেট দেয় এবং তার ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, পুলিশের বিবৃতি, ভিক্টিম মেয়েটির বোনের করা মামলার কপি এবং কোর্ট অর্ডারের পরও কিছু মিডিয়া আনভীরের নাম সামনে আনতে চায়নি। এর দ্বারা বাংলাদেশের মিডিয়ার উপর কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে সারা দেশের মানুষের কাছে, এমনকি তা লক্ষ্য করেছে গোটা বিশ্ব।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪৮ টি মিডিয়ার ৪০ টির মালিকপক্ষ ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি। এর ফলে দেশের ব্যবসায়িক আইকনেরা যেকোন ক্ষেত্রেই তাদের ব্যবসায়িক সহকর্মী, যারা মিডিয়া হাউজের সাথে জড়িত, কোন ঘটনার মোড় বদলে দিতে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে।
“অধিকাংশ মিডিয়াই ব্যবসায়ীদের দখলে যারা প্রায় প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত” ইফতেখারুজ্জামান, দ্য এ্যন্টি-গ্রাফট ওয়াচডগ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর জানান। “এর ফলে এমনকি প্রফেশনাল সাংবাদিকদেরও জোর করা হচ্ছে মালিকপক্ষের সুবিধা অনুযায়ী রিপোর্ট তৈরি করতে। এতে প্রকৃত সত্য গোপন হচ্ছে। এটা শুধুমাত্র স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ক্ষতিকর নয়, মিডিয়াও তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।”
এছাড়া, বাংলাদেশের মিডিয়ায় সেল্ফ সেনসরশীপ খুবই প্রচলিত ব্যাপার এখন। এর অন্যতম কারণ ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট। কঠোর এই অনলাইন আইনে ২০২০ সালে ৭৫ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস এর তৈরি করা স্বাধীন গণমাধ্যমের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে নিচে অবস্থান করছে— ১৫২ তম। এমন পরিস্থিতিতে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির ঘটনায় মিডিয়ার আচারণ খুব বেশি অপ্রত্যাশিত নয়।
“আমার মনে হয় না বসুন্ধরার গ্রুপ প্রত্যেকটা নিউজরুমে ফোন করে ঘটনাটাকে চেপে যেতে বলেছে”, পুঁজিপতিদের মালিকানায় থাকা একটি নিউজ ওয়েবসাইটের এডিটর এমনটা বলেন। জানা যায়, তাকেও এ ঘটনা সম্পর্কিত তিনটি প্রতিবেদন সরাতে হয়েছে। “আমি মনে করি সেল্ফ-সেনসরশীপে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যে অটোমেটিক্যালি আমরা নিউজ সেনসর করছি। নিউজ ফিল্টারিং শুরু হয় রিপোর্টারদের দিয়ে, কারণ তারা জানে তারে কিছু বিষয় গোপন না করলে তাদের স্টোরি পাব্লিশ করা হবে না। এরপর ডেস্ক এডিটর, সিনিয়র এডিটর, মালিকপক্ষ নিজে সেনসর করে নিউজ। আর এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাইরের চাপ ছাড়াই এসব করা হয়, শুধুমাত্র ভয় থেকে”।
যদি বসুন্ধরা গ্রুই এই আত্মহত্যার সাথে জড়িত থাকা আনভীরের নাম গোপনে মিডিয়াকে চাপ নাও দেয়, তারা সম্ভবত ভিক্টিম মেয়েটির চারিত্রিক অসঙ্গতি তুলে ধরতে চাপ দিয়েছে। দিলশানা পারুল, লিগ্যাল এইড এন্ড সারেভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর একজন বিশিষ্ট আইনজীবী তার ফেসবুক পোস্টে কীভাবে একটি সাজানো নাটকের মাধ্যমে অভিযুক্তের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভিক্টিমকে হেয় করতে ব্যস্ত মেইনস্ট্রিম মেডিয়া, তা উল্লেখ করেন।
অন্ততপক্ষে দু’টি নিউজপেপার— যাদের মালিকপক্ষ রিয়েল স্টেট এবং ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিজনেসের সাথে জড়িত, যা কিনা বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির ব্যবসায়িক ক্ষেত্র— তারাই মূলত এই সাজানো প্রতিবেদন পাব্লিশ করেছে, পুরোটাই বা আংশিকভাবে। এর ফলে কীভাবে দেশের শিল্পপতিরা নিজেদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে, নির্দোষদের বিপদে ফেলে, তা সামনে এসেছে।
অন্য আর একটি কারণ, যে জন্য মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এই সুইসাইডের ঘটনায় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির নাম সামনে আনতে চায়নি, তা হলো বসুন্ধরা গ্রুপ দেশের অন্যতম বড় বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান। একজন সাংবাদিক পাবলিকলি জানান, তার কাগজ আত্মহত্যার ঘটনায় আনভীরের নাম নেয়ায়, বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের সমস্ত বিজ্ঞাপন বাতিল করেছে।
বসুন্ধরা নিজেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মিডিয়া এমপায়ার চালায়। যার মধ্যে আছে প্রায় অর্ধ ডজন সংবাদমাধ্যম। দেশের সবথেকে বেশি প্রচারিত নিউজপেপার, টপ রেটেড নিউজ চ্যানেল। বসুন্ধরার মালিকানাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ এবং দ্য সান- এই তিনটি দৈনিক পত্রিকা। অনলাইন পোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোরও তাদের মালিকানাধীন। এছাড়া এই গ্রুপের রয়েছে নিউজ টোয়েন্টিফোর নামের টিভি চ্যানেল এবং ক্যাপিটাল এফএম নামের রেডিও স্টেশন।
বসুন্ধরার সর্বময় কর্তা আহমেদ আকবার সোবহান এই মিডিয়া এমপায়ার দাঁড় করিয়েছিলেন কারণ ২০০৬ ও ২০০৮ এর মধ্যবর্তী সময়ে একটি হত্যাকান্ড ও পরবর্তীতে একটি দুর্নীতির ঘটনায় প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার হাত ধুয়ে পিছে পড়েছিল তার দুই ছেলের, যাদের মধ্যে আনভীরও ছিলেন। বসুন্ধরা গ্রুপ সফলতার সাথে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মালিক ও এডিটরদের বিরুদ্ধে তাদের মিডিয়াকে ব্যবহার করে। তাদেরকে বসুন্ধরা নিয়ে প্রতিবেদন না করতে বাধ্য করে। দেশের লিডিং দুই সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করার এই ঘটনা, পরবর্তীতে অন্যান্য মেইনস্ট্রিম মিডিয়াকে তাদের খোঁচানোর ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ