খরস্রোতা পদ্মার ওপর সোয়া ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পথে। অথচ নদীর পরিস্থিতি অনুকূল থাকার পরও মাত্র ১ দশমিক ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাজ এখনো শেষ হয়নি। ২০১০ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) একই সাথে পদ্মা সেতু ও তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ৩ বছরে শেষ করার কথা ছিল তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণ কাজ। কিন্তু সময় লাগছে ১৩ বছর। তবুও কবে অব্দি সেতুর নির্মান কাজ শেষ হবে, তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। এদিকে, কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার কারণে যথাসময়ে বস্তবায়ন না হওয়ায় এ প্রকল্পে বাড়তি ব্যয় ২৩১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। সময়মতো কাজ হলে ৩৭৭ কোটি টাকায় নির্মাণ করা যেত সেতুটি। এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬১০ কোটি টাকায় উপরে।
অর্থায়নকারী সংস্থা এবং সরকারের টানাপোড়েন
১০ বছরেও তুলনামূলক ছোট এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ না হবার বড় একটি কারণ প্রকল্পে অর্থায়নকারী সংস্থা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং বাংলাদেশ সরকারের টানাপোড়েন ও খামখেয়ালি। ফলে প্রকল্পটির ব্যয় ও মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে।
বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বিলম্ব এবং ডিজাইন পরিবর্তনের কারণেই এমনটি হয়েছে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
সরকারের নিজস্ব তহবিল ও সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের (এসএফডি) ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। জানতে চাইলে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন আল- রশীদ বলেন, প্রকল্পটিতে মূলত যে সমস্যা হয়েছিল সেটি হচ্ছে বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে না পারা।
অর্থাৎ সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে অর্থায়নের আলোচনা হলেও তাদের এ দেশে কোনও অফিস নেই। ফলে তখন যারা প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন তারাও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারনেনি, কীভাবে ঋণ চুক্তিসহ পরবর্তী কাজগুলো করবেন।
এভাবে এ ঋণ চূড়ান্ত হতেই পেরিয়ে যায় প্রায় ৩ বছর। এরপর দরপত্র প্রক্রিয়ার সময় সৌদি ফান্ডের সম্মতি পেতে চলে যায় ৫-৬ মাস।
এছাড়া নকশায় নদীর যেখানে সেতু নির্মাণের কথা, সেখানে আগে থেকেই পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের (পিজিসিবি) হাইভোল্টেজ বৈদ্যুতিক লাইন রয়েছে। তাই সেতুর নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। আবার নতুন করে কিছু জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে।
নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধির বড় কারণ জমি অধিগ্রহণ, উপকরণের দাম বাড়া, মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও বেতন-ভাতা বাবদ খরচ। গত ১০ বছরে প্রকল্পটির পরিচালক বদল করা হয়েছে ১০ বার।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৬ বার
প্রকল্পের সার্বিক কাজ এখনও ২৫ শতাংশ বাকি। অথচ মূল প্রকল্পটি ২০১০ সালের নভেম্বর হতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু প্রথমবার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই এক বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর মধ্যেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় দ্বিতীয়বার ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়।
এভাবে তৃতীয়বার ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৬ মাস এবং চতুর্থবার একই বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাস মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন করা হয়। এ পর্যায়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে ৩ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়।
এতেও কাজ শেষ না হওয়ায় এবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রকল্পটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়ছে। এ পর্যায়ে দেড় বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ব্যয় বেড়েছে ২৩১ কোটি ৬৪ লাখ
প্রথম প্রকল্পটির ব্যয় ছিল ৩৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৬৫ কোটি ৯৮ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ হতে ৩১১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
পরে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হলেও এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব এখতিয়ারে বিশেষ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে ৫৩৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা করে। পরে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে আবারও ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৫৯৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
এবার দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে ৬১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ২৬৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ হতে ৩৪৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
এ সংশোধনীর কারণ হিসাবে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আইটি ও সিডি ভ্যাট খাতে ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া স্থানীয় পরামর্শক খাতে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা, লোকাল সাপোর্ট স্টাফদের বেতন খাতে ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং অন্য একটি খাতে বেড়েছে ২ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
সেই সঙ্গে ২ লেন অ্যাপ্রোচ সড়কের পরিমাণ ১ হাজার ৬৮১ মিটারের পরিবর্তে ৩৮৫ মিটার এবং ৪ লেন অ্যাপ্রোচ সড়কের পরিমাণ ৪৩১ মিটারের পরিবর্তে ১ হাজার ১৪২ মিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। সুপার স্ট্রাকচার অব ব্রিজ এবং সুপার স্ট্রাকচার অব ভায়াডাক্ট উভয় ক্ষেত্রেই দৈর্ঘ্য ৮৯০ মিটারের পরিবর্তে ৮৩৪ মিটার নির্ধারণ অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই সাড়ে ৫৫ মিটার দৈর্ঘ্য কমেছে।
এছাড়া ইউটিলিটি শিফটিং খাতে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারণেই প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধন করতে হচ্ছে।
বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শীতলক্ষ্যার ওপর ছয় লেনের এই সেতুটি দ্বারা সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে উপজেলার। তা ছাড়া নির্মাণাধীন পদ্মাসেতুর সঙ্গে বাইপাসের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-মাওয়া-খুলনা মহাসড়কে সংযোগ স্থাপিত হবে।
এমন গুরুত্বপূর্ণ সেতুর কাজ চলছে ১০ বছর। বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি। প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় শত শত মানুষ প্রতিদিন নৌকায় চড়ে শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিয়ে নারায়ণগঞ্জ সদরে যাতায়াত করে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী কাজী শাহরিয়ার হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় নির্মাণাধীন সেতুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সেতু। দেশের প্রশস্ত সেতুগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দর উপজেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চালু হবে। এছাড়া বাইপাসের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-মাওয়া সড়কের সঙ্গেও বন্দর এলাকার মানুষের সরাসরি সংযোগ ঘটবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু শীতলক্ষ্যা তৃতীয় সেতু নয়, সরকারের বেশির ভাগ অবকাঠামো প্রকল্পেই সময়ক্ষেপণ ও ব্যয় বাড়ানোর ঘটনা ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে সমীক্ষা ছাড়া, কোনও কোনও ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেওয়া হয়। বদলাতে হয় নকশা। দেরির মাশুল দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। আবার এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রকল্প আছে, যেদিকে সরকার নজরই দেয় না। অথচ সেসব প্রকল্প থেকে দ্রুত সুফল মেলে। মাত্র সোয়া কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতুর নির্মাণকাজ ১০ বছরেও শেষ হবে না, এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকার যদি নিজের টাকায় সেতুর কাজ করে ফেলত, সৌদি কর্তৃপক্ষ কি নিষেধ করত? মূল বিষয় হলো, এসব ছোট প্রকল্পের দিকে সরকারের মনোযোগ নেই। এসএফডির টাকা পাওয়া যাচ্ছে না, এটা অজুহাত হতে পারে, কারণ নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ