মাদারীপুরের শিবচরে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটের কাঁঠালবাড়ী ঘাট সংলগ্ন এলাকায় বাল্কহেডের (বালু টানা কার্গো) সাথে স্পিডবোটের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ২৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। সোমবার (৩ মে) ভোরে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। এরপরই নতুন করে নৌ-দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা ওঠে।
চলতি বছরের ৩ মে পর্যন্ত দেশে ১৪টি দুর্ঘটনায় ৭৮ জন যাত্রী নিখোঁজ হয়েছেন বলে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য থেকে জানা গেছে।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য বলছে, গত ১৬ বছরে দেশে নৌ-দুর্ঘটনায় ৯৪২ জন যাত্রী নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ পাঁচ বছরেই নিখোঁজ হয়েছেন ৬৯২ জন। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক যাত্রী নিখোঁজের ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে। ওই বছর ১৫১টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২৪৪ জন নিখোঁজ হন। এর বাইরে ২০১৬ সালে ১৫ জন, ২০১৮ সালে ১১৮ জন, ২০২০ সালে ২৩৭ জন এবং চলতি বছরের ৩ মে পর্যন্ত দেশে ১৪টি দুর্ঘটনায় ৭৮ জন যাত্রী নিখোঁজ হয়েছেন। আর গত পাঁচ বছরে সারা দেশে নৌ-দুর্ঘটনা হয়েছে ৩৬১টি। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৫৪২ জনের। আহত হয়েছেন ৩১৬ জন।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলছেন, নৌ-দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের মাত্র ১০ শতাংশের খোঁজ পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়। বাকি ৯০ শতাংশ নিখোঁজ ব্যক্তি আর কখনো ফিরে আসেন না।
নৌযান দুর্ঘটনার পর যাত্রী নিখোঁজ হওয়ার জন্য মোটা দাগে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান। তিনি জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, প্রথমত নৌযান দুর্ঘটনার পর অনেক যাত্রী সাঁতরে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তাদের অনেকেই হয়তো জীবন বাঁচাতে সফল হন না। এক্ষেত্রে যাদের মৃত্যু হয় তাদের লাশ দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সাঁতার না জানা ব্যক্তিদের লাশ স্রোতের টানে দ্রুত অনেক দূর ভেসে যায়। এ কারণে তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে নৌ-দুর্ঘটনার পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম দুর্ঘটনাস্থল ঘিরেই পরিচালনা করা হয়। যেসব লাশ এ সীমানার বাইরে চলে যায়, সেগুলো বলতে গেলে নিখোঁজই থাকে।
তৃতীয়ত, নৌপথে দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার অভিযান কার্যক্রম কেবল একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুর্ঘটনার ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই উদ্ধার অভিযান শেষ করে দেয়া হয়। এছাড়া নৌ-দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করতে দেরি করার কারণেও নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের ট্র্যাকিং করার একটা গাইডলাইন রয়েছে। দুর্ঘটনার প্রায় ৩০ দিন পর্যন্ত আহত ব্যক্তির খোঁজখবর রাখা হয়। কিন্তু নৌপথের জন্য এ ধরনের কোনো গাইডলাইন নেই। নৌপথে দুর্ঘটনা-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম ও আহত ব্যক্তিদের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক ওই দৈনিককে বলেন, নৌপথে দুর্ঘটনার পর উদ্ধার অভিযানে কোনো ধরনের ত্রুটি থাকে না। তবে আমাদের প্রথম চেষ্টা থাকে দুর্ঘটনা রোধ করা। এজন্য দেশের নৌপথগুলোকে নিরাপদ রাখতে কাজ করে যাচ্ছি। তার পরও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো ঘটছে মূলত নৌযানের মালিক-চালক ও যাত্রীদের অসচেতনতার কারণে। আজকের (গতকাল) দুর্ঘটনার কথাই যদি বলি, বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ঘাট দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে যাত্রী পারাপারের জন্য ফেরি সার্ভিস চালু থাকা সত্ত্বেও যাত্রীরা স্পিডবোটে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেছে। নিরাপদ ফেরি সার্ভিস থাকার পরও যাত্রীরা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও অবৈধভাবে স্পিডবোটে উঠেছে।
তিনি বলেন, আমরা সবাই যদি সচেতন না হই, তাহলে যতই অভিযান পরিচালনা করা হোক না কেন, অবৈধ স্পিডবোট চলাচল বন্ধ করা সম্ভব নয়।
নৌ-চলাচল আইন ৫ বছরেও হয়নি
নৌ-দুর্ঘটনায় মালিক ও চালকরা দায়ী হলেও বরাবরই তাদের পক্ষেই নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তরের অবস্থান। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপের কারণে গত কয়েক বছরেও অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ সংশোধন হয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল আইনে রূপ নেয়নি। এসব সংগঠনের অনুরোধে বারবার তাদের মতামত নেওয়ার জন্য সময়ক্ষেপণ করা হয়। শুধু তাই নয়, আইনে বারবার সাজা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও তা থেকে সরে আসা হয়।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে নৌ-দুর্ঘটনার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের বিধান রাখা হলেও চাপের মুখে তা আবার ৫ বছর করে খসড়া তৈরি করে নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তর। ওই খসড়া নিয়ে এখনো কাজ করছে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়।
২০১৫ সালে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দফায় দফায় মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। ২০১৯ সালে খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সিরিজ বৈঠকে ১০ বছর সাজার বিষয়টি মেনেও নেওয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা আবার ফিরিয়ে এনে এখন ধাপে ধাপে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের বিধান রাখা হচ্ছে। এমনকি এ সাজার বিধান এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
আইন সংশোধনে বারবার সময়ক্ষেপণ ও সাজা কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এমন কোনো আইন করা উচিত হবে না যা বাস্তবায়ন বা প্রয়োগ করা যাবে না। এমন আইন করতে হবে যা প্রয়োগ করা যায়।
তিনি বলেন, যেহেতু এ আইন বাস্তবায়নের সঙ্গে মালিক ও শ্রমিকরা বেশি সম্পৃক্ত তাদের কথাও ভাবতে হবে। যাত্রী নিরাপত্তা, নৌপথের শৃঙ্খলা ঠিক থাকে এমন আইনই হচ্ছে।
মার্চেও নৌযান মালিকসহ স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করেছে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকেও বিভিন্ন অপরাধ ও বিধি লঙ্ঘনের জন্য বিদ্যমান সাজা আরও কমিয়ে জাহাজের আকার অনুযায়ী সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা এবং এক মাসের কারাদণ্ডের প্রস্তাব করেছে মালিকদের ছয়টি সংগঠন। তারা নৌযানের বয়সসীমা ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ বছর করার প্রস্তাব করেছে। ওই বৈঠকে বিআইডব্লিউটিএ, নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন মতামত দেওয়া হয়। তবে কোনো সংস্থাই বিদ্যমান সাজা বাড়ানোর পক্ষে মতামত দেয়নি।
নৌ-দুর্ঘটনা রোধে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
নৌ-দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। একে অপরকে না দুষে সম্মিলিত প্রচেষ্টাই দুর্ঘটনা থেকে উত্তরণের পথ। নৌপরিবহন সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে প্রশাসনিকভাবে আরো সক্রিয় হতে হবে। নৌচালক, মাস্টার, বন্দর তত্ত্বাবধায়ক ও যান মালিকদের কর্মকাণ্ডও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্সবিহীন চালক ও যানগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের নৌ পরিবহন সংক্রান্ত কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। আইন অমান্যকারীদের ভ্রাম্যমাণ আদালত বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তায় আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিআইডব্লিউটিএ বা এ জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাস্টার, চালক ও যান চালনায় সম্পৃক্ত সকলকে বাৎসরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বছরে একবার হলেও যানের ফিটনেস পরীক্ষা করতে হবে। বড় যাত্রীবাহী নৌকাসহ সকল লঞ্চ, জাহাজ বা স্টিমারে ওয়াটারপ্রুফ কক্ষ নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীবাহী বড় জাহাজ বা জলযানে জীবন রক্ষাকারী ছোট নৌকাসহ আনুষঙ্গিক উপকরণ আছে কিনা যাত্রার পূর্বেই তা পরীক্ষা করতে হবে।
যাত্রার অব্যবহিত আগে দুর্ঘটনার কবল থেকে উদ্ধার হওয়ার উপায় সংক্রান্ত নির্দেশনা যাত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রদান করতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় লঞ্চে বা ফেরিতে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও যাত্রী সাধারণের অজ্ঞতার কারণে তা অব্যবহৃত থেকে যায়। সাঁতার না জানা যাত্রীদের জীবন রক্ষাকারী জ্যাকেট সরবরাহের ব্যবস্থাও করতে হবে।
অতিরিক্ত যাত্রী বহন কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সাথে সাথে যাত্রীদের নিজেদেরকেও সচেতন হতে হবে। কারণ ঈদ বা পুজাপার্বণে ঘরমুখো মানুষের ঢল দেখে বোঝা যায় যে, যাত্রীদেরও দোষ কোনো অংশে কম নয়। নৌযান কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করেও অনেকে অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে ভ্রমণ করে দুর্ঘটনার পথকে ত্বরান্বিত করে থাকে। তাছাড়া দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় অধিকতর দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালকসহ ভালো মানের যান চলাচলের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ