বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বজুড়ে হিমবাহ ও বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের আয়তন কমে যাচ্ছে বলে দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। মহামারি করোনার কবলে পড়ে মানুষের অক্সিজেন সংকট নতুন করে আলোচনায় এলেও এতে টনক নড়ছে না কারও। অক্সিজেন বৃদ্ধিতে একদিকে যেমন পরিকল্পনার অভাব তীব্র হচ্ছে অন্যদিকে নানা অজুহাতে কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে নাশ করা হচ্ছে বনভূমি।
বাংলাদেশের অক্সিজেন কারখানাখ্যাত সুন্দরবন প্রায়ই আগুনের কবলে পড়ে। এতে পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বনভূমি ও বনের প্রাণীরা। আজও সুন্দরবনের লোকালয়সংলগ্ন একটি এলাকায় আবারও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার অন্তর্গত সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
তবে আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে এখনো কিছু জানাতে পারেনি বন বিভাগ।
আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেছে বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস। আগুন যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, এ জন্য বনের মধ্যে দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ফায়ার লাইন কাটা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বাগেরহাট স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক মো. গোলাম ছরোয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, সুন্দরবনে আগুন লাগার খবর পেয়ে শরণখোলা স্টেশনের একটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে গেছে।
তবে ওই এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ভালো না থাকায় ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে ঠিকমতো যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি। তাই আগুনের ব্যাপ্তি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বেলা ১১টার দিকে বনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানী ফরেস্ট ক্যাম্পের প্রায় ১ কিলোমিটারের ভেতরে আগুনের ধোঁয়া দেখতে পায় বনকর্মীরা। দুপুর থেকে স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার লাইন কাটার কাজ শুরু করেছে। আগুনের ব্যাপ্তি যাতে বাড়তে না পারে সেজন্য বনকর্মীরা ফায়ার লাইন কাটার কাজ করেছেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করা যাবে।
তবে কী কারণে আগুন লেগেছে বা কী পরিমাণ গাছপাল পুড়েছে, সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক কিছু জানাতে পারেননি তিনি। তবে স্থানীয়রা বলছে, প্রায় দুই একর এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা সদর থেকে সুন্দরবনের দুরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। রায়েন্দা ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে মরা ভোলা নদী।
এই নদী পার হয়ে সুন্দরবন। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের দাসের ভারানি টহল ফাঁড়ি। এই এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ রাজাপুর, মাঝেরচর ও রসুলপুর গ্রামের শতাধিক গ্রামবাসী আগুন নেভানোর কাজে যোগ দিয়েছে।
আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়া দক্ষিণ রাজাপুর, মাঝেরচর ও রসুলপুর গ্রামের আবজাল চাপরাশি, রেজাউল ও সুমন বলেন, সুন্দরবনের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরা শতাধিক গ্রামবাসী সেখানে ছুটে এসেছি। আমরা বাড়ি থেকে কলসি, বালতি, জগ ও হাড়ি নিয়ে পাশের ভোলা নদী থেকে পানি নিয়ে একদল গ্রাবাসী আগুন লাগার স্থানে ছিটাচ্ছি।
মরা ভোলা নদী থেকে আগুন লাগার স্থানের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। দূরে হওয়ায় পানি পেতে কষ্ট হচ্ছে। এখানে অন্য কোনো পানির উৎস নেই। যার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। প্রায় দুই একর এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বলে তাদের ধারণা।
জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালদের ফেলে দেয়া বিড়ি সিগারেটের আগুন থেকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। তবে কতটুকু এলাকায় আগুন ছড়িয়ে কি ধরনের গাছপালা পুড়ছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। পরে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করে জানানো হবে।
এর আগে ৮ ফ্রেরুয়ারি বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর টহল ফাঁড়ির কাছে ২৭ নম্বর কর্ম্পাটমেন্টের বনে আগুন লেগে পুড়ে যায় ৫ শতক বনের গাছপালা ও লতাগুল্ম।
সুন্দরবন বিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবনে ১৫ বছরে ২৮ বার আগুন লেগে পুড়ে যায় প্রায় ৮০ একর বনভূমি। ২০১৭ সালের ২৬ মে পূর্ব সুন্দরবনে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ফরেস্ট ক্যাম্পের আওতাধীন আবদুল্লাহর ছিলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই আগুনে প্রায় পাঁচ একর বনভূমির ছোট গাছপালা, লতাগুল্ম পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের সাথে মানুষের চিরায়ত এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বিপরীতভাবে বনের সাথে মানুষের রয়েছে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক। বনকে চিরায়ত শত্রু হিসাবেই ব্যবহার করা হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। বন সাবাড় করে মানুষের আজকের যে সভ্যতা, সেটাও দাঁড়িয়ে আছে এসব বনের কারণেই। কোনো দেশের বনকে সেদেশের হৃৎপিণ্ড বলা হয়। বাংলাদেশেও সুন্দরবন নামে একটি হৃৎপিণ্ড রয়েছে। যেটাকে ক্রমাগতভাবে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে আর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমাদেরই। সুন্দরবন রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে কলমে থাকলেও বাস্তবে কার্যত হয় এর উল্টোটাই।
তারা বলেন, সুন্দরবনের চতুর্দিক থেকে গলা চেপে ধরেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনটি দূষণ ও শিল্পকারখানার চাপে হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে লবণাক্ততার সমস্যা আগে থেকেই ছিল, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণ। একদিকে চোরা শিকারিদের হাতে মারা পড়ছে জঙ্গলের বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী, অন্যদিকে থেমে নেই বনটির অভ্যন্তরে নদীর পানিতে বিষ দিয়ে মাছ নিধন। এর মধ্যে যোগ হয়েছে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
তারা বলেন, বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। বিভিন্ন কারণে সংঘঠিত অগ্নিকাণ্ড ও নাশকতার আগুনে বনের গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় অনেকটা ফাঁকা অনুভব হচ্ছে সুন্দরবন। প্রাকৃতিক এ বনকে চিরচেনা রূপে ফিরতে কিংবা অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত শুকাতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। প্রাণী ও মৎস্য এবং মধুসহ বনের সম্পদ লুটতে একাধিক চক্র সক্রিয় হওয়ার কারণে বার বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। অভিযোগ রয়েছে, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের জন্য উপযোগী এলাকা তৈরির জন্য আগুন লাগানো হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও প্রাণবৈচিত্র্য বাংলাদেশের অমূল্য জৈব সম্পদ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে এটা দক্ষিণাঞ্চলের পরীক্ষিত রক্ষাকবচ। সুন্দরবনকে বাঁচাতেই হবে। সুন্দরবনের আগুন–সন্ত্রাসীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষঞ্জদের মতে, দফায় দফায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুন্দরবনের ওইসব স্থানের জীবজন্তু, পশুপাখি অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া এভাবে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সুন্দরবন সুরক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ