পৃথিবীর ইতিহাসে যে ঘটনাগুলি যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত করেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হল ‘মে দিবস’! প্রশ্ন হল এতগুলি বছর পরেও আজও কেন ‘মে দিবস’ এত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু? ঐতিহাসিক আঙ্গিকে দেখলে বলা যায় পৃথিবীর ইতিহাস চিরকাল ধনী দরিদ্র, মালিক শ্রমিক, শোষক শোষিতে বিভক্ত! পৃথিবীর আদি অনন্তকাল থেকে দুর্বলেরা সবলদের হাতে অত্যাচারিত উৎপীড়িত! মার্ক্সের মতে পৃথিবীর মনুষ্য সমাজের ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি একে বুর্জোয়াদের (পুঁজিপতি ও বণিকশ্রেণী) সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের (সর্বহারা) সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন!
তিনি মানব সভ্যতার ইতিহাসকে ছয়টি ভাগে ভাগ করেছেন- আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ, বুর্জোয়া সমাজ, প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র ও সাম্যবাদী সমাজ। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীরা মানব সভ্যতাকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করলে ও মানব সভ্যতার সৃষ্টি থেকেই ‘Have’s or Have’s not’ দের লড়াই চলছে! ‘মে দিবস’ আসলে সেই সমস্ত শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই! পৃথিবী যতদিন থাকবে, পৃথিবীতে যতদিন শোষক ও শোষিত থাকবে ততদিন শ্রমজীবী মানুষের নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম চলবে। এই আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লড়াইয়ের অপর নাম হল ‘মে দিবস’!
ঐতিহাসিক আঙ্গিকে দেখলে বলা যায় পৃথিবীর আদিম সমাজ ব্যবস্থায় সকলে একসঙ্গে কাজ করত, শিকার করত এবং যে জিনিস পেত সকলে একসঙ্গে ভাগ করে খেত, পন্ডিতেরা একে ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজ’ ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেন। ধীরে ধীরে সমাজ সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির ধারণার জন্ম হয় এই পর্বে মানুষ বিভিন্ন জিনিস উৎপাদন করত এবং প্রয়োজনীয় জিনিস পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করত, এই বিনিময় ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরে চলেছিল। পরবর্তীকালে কড়ি ও বিভিন্ন বিবর্তনের মাধ্যমে মুদ্রা ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। এই মুদ্রা, অর্থ ও ব্যাক্তিগত সম্পত্তির ধারণার পর থেকেই মানুষের চিন্তা চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল এবং আরও চাই এর নেশা মানুষকে পেয়ে বসল। প্রথম দিকে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ও পরবর্তীতে বাণিজ্যের মাধ্যমে একশ্রেণীর মানুষ ধনবান হতে শুরু করে। পরবর্তীকালে সমাজে এই ধনী সম্প্রদায় দুর্বল সম্প্রদায়কে অত্যাচার করতে শুরু করল এভাবে সমাজে শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি হল।
বিভিন্ন দলের মধ্যে শক্তিশালী মানুষরা দলপতিতে নির্বাচিত হতেন এবং বিভিন্ন দলপতিদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে রাজার উৎপত্তি হল সেইসঙ্গে সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হল। সাম্রাজ্য সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণীর রাজা সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে অপর সাম্রাজ্যকে আক্রমণ করত, যুদ্ধে যারা হেরে যেত তাঁদের সকলকে দাস বানিয়ে রাখা হত। এভাবে আদিম সাম্যবাদী সমাজ ধীরে ধীরে ‘দাস সমাজে’ পরিবর্তিত হল। এই দাসদের কোন অধিকার ছিল না তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হত। আমরা জানি রোম সাম্রাজ্যে দাসেদের সঙ্গে দাসের বা দাসের সঙ্গে হিংস্র পশুর লড়াই খেলা হিসাবে উপভোগ করা হত, কোন একপক্ষ যতক্ষণ না মারা যেত এই খেলা চলত! অর্থাৎ দাসদের জীবন, মানুষের জীবন হিসাবে গণ্য করা হত না! দীর্ঘদিন এরূপ অন্যায়, অত্যাচার, বঞ্চনার পর দাসেরা মাঝে মধ্যে তাঁদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিদ্রোহ করত, তবে শাসক শ্রেণী তা নির্মম ভাবে দমন করত!
এই দাস ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে ভিত্তি করেই কোথাও কোথাও শক্তিশালী রাজতন্ত্রের সৃষ্টি হয় যেমন- রোমান সাম্রাজ্য পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য যা প্রায় হাজার বছর টিকেছিল। সমাজে দাসেদের সঙ্গে গরীব ও দুর্বল শ্রেণীর মানুষ শাসক, যাজক ও বণিক শ্রেণীর দ্বারা শোষিত হত! এই দাস ও শ্রমিকজীবী মানুষের পরিশ্রমে সভ্যতার ইমারত গড়ে উঠেছিল কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা ছিল বঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত! সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম মিশরের পিরামিড, আগ্রার তাজমহল, চীনের প্রাচীর এগুলি সবই শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগ, তিতিক্ষা ও পরিশ্রমে গড়া কিন্তু তাঁদের কথা আর কে মনে রেখেছে? তাঁদের পরিণতি কি হয়েছিল এবং তাঁরা আদেও মানবেতর জীবন পেয়েছিল কিনা তা কে জানে?
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের অভাব অনুভূত হয়, বিভিন্ন বর্বর বিদেশি আক্রমণ, প্লেগ ইত্যাদি মহামারীর ফলে ইউরোপের রাজপরিবার গুলির শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। ইসলামের প্রসারের পর ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা গভীর সংকটের মধ্যে পড়ে। সপ্তম শতকে ভূমধ্যসাগর কার্যত ‘মুসলমান হ্রদে’ পরিণত হয় এর ফলে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ গুলি আক্রান্ত হয়, শিল্পায়ন ও নগরায়ন অবহেলিত হয়, আমদানি ও রপ্তানি প্রভাবিত হওয়ার ফলে ইউরোপ কার্যত এক বদ্ধ অর্থনীতিতে (Closed Economy) পরিণত হয়। এমতাবস্থায় অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে কৃষি। এই কৃষিকেন্দ্রীক অর্থনীতির ফলে ভূস্বামী বা লর্ডদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দুর্বল রাজ শাসনের ফলে এই ভূস্বামীরা পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের সর্বেসর্বাতে পরিণত হয় এবং এভাবে ‘ম্যানার’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ইউরোপে ‘সামন্ততান্ত্রিক’ সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়।
এই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ভূস্বামীরা অনেক সময় তাঁদের স্বাধীন প্রজাদের ‘সার্ফ বা ভূমিদাস’ বানিয়ে রাখত! এই সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ইউরোপ তথা বিশ্বব্যাপী কয়েক শতাব্দী চলেছিল। সভ্যতার ইমারত যে ভূমিদাসদের শ্রমের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল কার্যত তাঁদের স্বাধীনভাবে জীবন নির্বাহের অধিকার ছিল না! পরবর্তীকালে ইউরোপে পুনরায় প্লেগ, ব্ল্যাক ডেথ ইত্যাদির মতো মহামারী দেখা দেয়। এই মহামারী গুলি ইউরোপের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই মহামারীর কবলে পড়ে ইউরোপের কোটি কোটি মানুষ মারা যায়, কোন কোন পন্ডিতের মতে এরফলে ইউরোপের জনসংখ্যা প্রায় 35% কমে গিয়েছিল। ফলে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল, শহর গুলি শ্রীবৃদ্ধি হারিয়ে ছিল এরফলে ভূমিদাসদের অভাবে সামন্ততন্ত্র টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে ওঠে। এই সময় ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজতন্ত্রের প্রসার ঘটে, ফলে সামন্তরা দুর্বল হয়ে পড়ে। বহু ক্ষেত্রে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আধুনিক শিল্পের বিস্তার ঘটতে থাকে। শ্রমিকের অভাবে মজুরি বৃদ্ধি পায় এবং বহু জায়গায় ভূমিদাসরা স্বাধীন হওয়ার সুযোগ পায়।
এভাবে সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছিল তবে এই মহামারী গুলি মানুষের মনে তীব্র প্রভাব বিস্তার করে। আগে মানুষ মনে করত এই মহামারী গুলি মানুষের পাপের ফল, ঈশ্বর এভাবে মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে। তাঁরা মনে করত তাঁদের এই দুর্দিনে চার্চ ও পোপ এই মহামারী থেকে তাঁদের রক্ষা করবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল পোপ ও চার্চ মানুষকে এই মহামারী থেকে রক্ষা করতে পারল না, এরফলে ইউরোপের এক বিরাট অংশের মানুষের মনে ধর্মের প্রভাব কমতে থাকল। মানুষ নতুন করে চিন্তা করতে শিখল এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করল। তখন থেকেই মানুষ সমস্ত কিছুকে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল। এরফলে সমাজে জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার শুরু হল। সমাজে ‘রেনেসাঁস বা নবজাগরণ’ দেখা দিল। রেনেসাঁসের প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেখা গেল। মানুষ এবার থেকে ঈশ্বরকে সাহিত্যের মূল চরিত্র না করে মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনা করতে লাগল। অন্যদিকে চিত্রশিল্পে দেখা যায় যীশু, ঈশ্বর ইত্যাদির পরিবর্তে মানুষের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে চিত্র শিল্প আঁকা শুরু হল। এভাবে সমাজের ব্যাপক পরিবর্তন সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য ইত্যাদির মধ্যে ফুটে ওঠে।
পেত্রার্ক (রেনেসাঁসের শুকতারা), দান্তে, বোকাচ্চিয় প্রভৃতি দার্শনিকদের মানবতাবাদী দর্শন মানুষকে নতুন করে চিন্তা করতে শিখিয়েছিল এবং মানবতাবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এরফলে পরবর্তীকালে ইউরোপের মানুষ চার্চের অনৈতিকতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে ওঠে। জন ওয়াইক্লিফের নেতৃত্বে (1324-84) ধর্ম সংস্কার আন্দোলন প্রথম সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল তাই তাঁকে ‘ধর্মসংস্কার আন্দোলনের শুকতারা’ বলা হত। পরবর্তীকালে ‘মার্টিন লুথারের’ নেতৃত্বে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে ‘প্রটেষ্টান আন্দোলন’ শুরু হয় যা সমাজকে আরও উন্মুক্ত ভাবে চিন্তা করতে শেখায়। এভাবে ধীরে ধীরে মানুষ ধর্মের সংস্কার মুক্ত হয়ে আধুনিক চিন্তার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এর ফলে মানুষ বৈজ্ঞানিক চিন্তার দিকে ঝুঁকতে থাকে এবং নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে শেখে। ধীরে ধীরে এই ‘রেনেসাঁসের’ প্রভাবে ইউরোপীয় সমাজ সভ্যতা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হয়!
বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সময় ফ্রান্সিস বেকন, রজার বেকন, কোপারনিকাস, নিউটন, গ্যালিলিও, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, উইলিয়াম হার্ভে প্রভৃতি বিজ্ঞানিদের আবিষ্কারের ফলে ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান সহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হয়। পরবর্তীতে এই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে ভিত্তি করেই সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয় যেমন- 1733 খৃষ্টাব্দে জন কে ‘ফ্লাইং শাটল বা উড়ন্ত মাকু’ নামে এক উন্নত মানের কাপড় বোনার মেশিন আবিষ্কার করেন।1765 খৃষ্টাব্দে হারগ্রিভস আবিষ্কার করেন সুতা কাটার উন্নত যন্ত্র ‘স্পিনিং জেনি’। 1769 খৃষ্টাব্দে জেমস ওয়াটের ‘বাষ্প ইঞ্জিন’ আবিষ্কার করেন। জন মিল্টন কাঠকয়লার পরিবর্তে কয়লার সাহায্যে লোহা গলানোর চুল্লি বা ‘ব্লাস্ট ফার্নেস’ আবিষ্কার করেন, হামফ্রে ডেভির ‘সেফটি ল্যাম্প’ (1815) খনির কাজ নিরাপদ করে। 1814 সালে জর্জ স্টিভেনসন ‘বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিন’ ও 1815 খৃষ্টাব্দে ফুলটন ‘বাষ্পীয় পোত বা স্টিমার’ আবিষ্কার করেন। এই সমস্ত বিজ্ঞানীদের বহুমুখী আবিষ্কারের ফলে উৎপাদন ও পরিবহন ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয় যা শিল্পবিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে! এভাবে পুঁজি, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হয়।
শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার ফলে ইউরোপের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। মানুষ কাজের খোঁজে ও উন্নত জীবনযাত্রার আশায় দলে দলে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে যাত্রা শুরু করে। এর ফলে গ্রামগুলি কার্যত জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং শতাব্দীব্যাপী সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে আধুনিক ‘শিল্প বিপ্লব’ সংগঠিত হয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন সংগঠিত হয় প্রথম দিকে মানুষ দাস প্রথা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন শ্রমিক হিসাবে কারখানায় যোগাদান করে খুশি ছিল, সেইসঙ্গে নারীরা ঘরের পুরুষতন্ত্রের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে কারখানায় স্বাধীন শ্রমিক হিসাবে যোগদান করায় খুশি ছিল। কারণ বেতন কম হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে মুক্তির স্বাদ এবং নিজের স্বাধীন সত্তায় নারী সমাজ প্রসন্ন ছিল! এই অবস্থা দীর্ঘদিন এক রকম ছিল না, পুঁজিপতিরা নাম মাত্র পারিশ্রমিকে শ্রমিকদের 14-18 ঘন্টা কাজ করিয়ে নিত। সেখানে না ছিল কোন সামাজিক সুরক্ষা, না ছিল কোন নিরাপত্তা, নোংরা পরিবেশে শ্রমজীবী মানুষদের কাজ করতে হত। সভ্যতার ইমারত গড়ে উঠেছিল এই শ্রমিক শ্রেণীর পরিশ্রমে কিন্তু এই শ্রমিক শ্রেণী শোষণ ছাড়া কার্যত আর কিছুই পেত না! অত্যাচার যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে মানুষ তখন প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করে, তেমনি এক প্রতিবাদ প্রতিরোধের অপর নাম হল ‘মে দিবস’!
শ্রমিকেরা কয়েক বছর আগে থেকেই নিজেদের দাবি দাওয়া মালিক পক্ষকে জানালেও মালিক শ্রেণী এতে রাজি ছিল না। মে দিবসের কিছুদিন আগেও শ্রমিকেরা নিজেদের দাবি আদায়ের পক্ষে আন্দোলন করলে মালিক শ্রেণী পুলিশ দিয়ে তাঁদের দমানোর চেষ্টা করে কিন্তু এর ফলে প্রতিবাদী শ্রমিকেরা আরও সংগঠিত হয় এবং আরও তীব্র বেগে আন্দোলন চলতে থাকে। এরপর এসে গেল সেই ঐতিহাসিক দিন 1886 সালের 1 মে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সামনে 8 ঘন্টা শ্রমের দাবিতে শ্রমিকেরা সমবেত হন। তাঁদের দাবি ছিল ‘আট ঘন্টা কাজ, আট ঘন্টা বিশ্রাম ও আট ঘন্টা আমোদ প্রমোদ ও চিন্তার অবকাশ’ দিতে হবে। শ্রমিকদের আন্দোলন চলাকালিন সময়ে এক অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতী বোমা নিক্ষেপ করে, বোমার আঘাতে একজন পুলিশ মারা যায় এবং পুলিশের পাল্টা গুলিতে 11 জন আন্দোলনকারী নিহত হয়। পুলিশ এই ঘটনার জন্য আন্দোলনকারী নেতাদের গ্রেফতার করে।
উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও প্রহসনের বিচারে বিচারক আন্দোলনকারী নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির সাজা শোনায়। 6 জনের ফাঁসির আদেশ হলেও ফাঁসি কার্যকর করার আগের দিন লুইস কিং নামে এক অভিযুক্ত আত্মহত্যা করেন। 1887 সালের 11 ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ‘পার্সনস, ফিসার, এঞ্জেলস ও অগাস্ট স্পাইস’ এই চারজন শ্রমিক নেতার ফাঁসি দেওয়া হয়। ফাঁসির পূর্বে শ্রমিক নেতা ‘অগাস্ট স্পাইস’ তাঁর বিশ্ববিখ্যাত উক্তিটি করে যান, তিনি বলেন- ‘আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে।’ অগাস্ট স্পাইসের সেই কথাগুলি ব্যার্থ হয়নি তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের বলিদান বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে এবং গোটা বিশ্বে আট ঘন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন হতে থাকে। ইতিহাস সাক্ষী পৃথিবীর শাসকরা আট ঘন্টা কাজের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল যদিও বহু শাসক ও পুঁজিপতিরা আজও শ্রমিকদের কাছ থেকে এই অধিকার কেড়ে নিতে চাই। তবে 1893 সালের 26 জুন ইলিয়নয়ের গভর্নর বিচারে দোষী সাব্যস্ত শ্রমিক নেতাদের সকলকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা করেন।
এই ঘটনাটি বিশ্বের শ্রমিকদের তীব্র ভাবে নাড়া দেয়, তাঁরা নিজেদের দাবি দাওয়া আদায়ের পক্ষে একত্রিত হতে থাকে। মে দিবসের আগেই 1864 খৃষ্টাব্দে কার্ল মার্কসের নেতৃত্বে লন্ডনে প্রথম ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেনশ অ্যাসোসিয়েশন’ সংগঠিত হয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী বিপ্লব সংগঠিত করা। এরপর মার্ক্সের মৃত্যুর পর 1889 খৃষ্টাব্দে ফ্রেডারিখ এঞ্জেলসের নেতৃত্বে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সংগঠিত হয়, এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রতি বছর 1 মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালন করা হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর 1919 খৃষ্টাব্দে তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল স্থাপিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দেশে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তবে এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) গঠন করা হয়, এদের কাজ ছিল বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা ও আট ঘন্টা কাজের দাবিকে আইনত বৈধতা প্রদান করা। বলাই বাহুল্য ILO এর প্রচেষ্টায় বর্তমানে 8 ঘন্টা কাজের দাবি বিশ্বব্যাপী আইনি অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রথম দিকে শ্রমঘন্টা, কাজের মূল লক্ষ্য হলেও পরবর্তীতে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা ও তাঁদের স্বার্থরক্ষা করাই ILO এর প্রধান কাজ হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন হল আজও কি শ্রমিকেরা তাদের কাঙ্ক্ষিত অধিকার পেয়েছে?
অপ্রিয় সত্য হল না আজও শ্রমিকেরা তাদের কাঙ্ক্ষিত অধিকার পায়নি বরং পুঁজিনির্ভর অর্থনীতিতে প্রতিদিনই তাঁদের অধিকার সংকুচিত করার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যেই ILO সতর্ক করেছে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় 160 কোটি মানুষ কাজ হারাতে পারে। বিশ্বব্যাপী এই করোনা মহামারীর সময় ভারত, আমেরিকার মতো দেশে শ্রমিকদের উপর তীব্র শোষণ চালানোর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে! শোনা যায় ভারত সরকার আগামী কয়েক বছর অর্থনৈতিক পুনর্জীবনের উদ্দেশ্যে কাজের সময় বৃদ্ধি করে 8 ঘন্টার পরিবর্তে 12 ঘন্টা করতে চাই। ইতিমধ্যে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাটের মতো রাজ্য এইদিকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গেছে ধীরে ধীরে রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলি ও এদিকে এগোচ্ছে।
একটি পরিসংখ্যান দিলেই বুঝতে পারবেন বর্তমানে ভারতে শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা কতটা সংকটজনক। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ভারতে মোটামুটি কাজের সুযোগ রয়েছে 40 কোটি মানুষের। অন্যের কাছে কাজ করেন প্রায় 21.5 কোটি ও রোজ কাজ পান প্রায় 7 কোটি মানুষ। 13 কোটি মানুষ অনিয়মিত লেবার। সরকারি তথ্য 2015-16 থেকে জানা যায় শহুরে লেবারদের 70% এর কাছে কোন লিখিত কন্ট্রাক্ট নেই, 30% এর কাছে কন্ট্রাক্ট আছে, অর্থাৎ যদি কোন সমস্যা হয় এই 70% শ্রমিক কাজ করেছে কি না, তা তাঁরা প্রমাণ করতে পারবে না। 30% মানুষের মাসিক যা খরচ হয় তার চেয়েও কম আয় করে এবং এই 30% গ্রামীণ পরিবারের মাসিক আয় 4000 টাকার নিচে, তাই তাঁরা যে কোন কাজ করতে আগ্রহী। এই জন্য এত বেশি পরিযায়ী শ্রমিক দেখা যায়।
এবার দেখা যাক এই শ্রমিকদের মাসিক আয় কত? ভারত সরকারের 2015-16 অর্থ বছরের তথ্যকে বর্তমান সময়ের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন- ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী প্রায় 21.5 কোটি মানুষ যারা অন্যের কাছে কাজ করেন তাঁদের 45% মানুষের মাসিক আয় 5000 টাকার কম, বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করলে বলা যায় বর্তমানে 45% শ্রমিকের মাসিক আয় 5800 টাকার কম। 5801-8700 পর্যন্ত আয় করেন 23% শ্রমিক, 8701-11600 টাকা আয় করেন 25% শ্রমিক। 11601-23200 টাকা পর্যন্ত আয় করেন 15% শ্রমিক। অর্থাৎ মোট শ্রমিজীবী মানুষের 94% এর মাসিক আয় 23200 টাকার কম। আর 80% শ্রমিকের মোট মাসিক আয় 11600 টাকার কম। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে সভ্যতার ইমারত যে শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে তারা আজ কতটা শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত! মনে করা হয় ব্যাক্তিগত ব্যাবসা থাকলে আয় বেশি হবে কিন্তু বিভিন্ন তথ্যে দেখা যাচ্ছে নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে এমন মানুষের 96% এর আয় 23200 টাকার কম। এটাই আমাদের দেশের করুন অবস্থা! এই পরিসংখ্যানে এটাও স্পষ্ট হয়েছে, এই কয়েক বছরে ভারতের যুব সমাজ সরকারি চাকরির দিকে বেশি ঝুঁকছে। এই যদি দেশের অর্থনীতির অবস্থা হয় তাহলে আগামী দিনে কি হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়! (তথ্যসূত্র- News click)
অথচ একশ্রেণীর অর্থনীতিবিদ ও সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা বলছেন সরকারকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরও সংস্কার করা উচিত, শ্রম আইন সহজ করা উচিত যাতে অর্থনীতি আরও গতি পায়। এখন প্রশ্ন হল এই সংস্কার বলতে কি বোঝাচ্ছে? এখানে সংস্কার বলতে পুঁজিপতিদের আরও সুযোগ সুবিধা প্রদান করা, যত খুশি শ্রমঘন্টা বাড়ানোর অধিকার, যখন তখন শ্রমিককে ছাঁটাই করার অধিকার, নূন্যতম মজুরিতে কার্যত শ্রমদাসত্ব করার অধিকার ইত্যাদি। অর্থাৎ এক কথায় শ্রমিককে শ্রমদাসত্বের পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। তা প্রশ্ন হল ইহাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদার সংস্কার? ইহার ফলেই অর্থনীতি চাঙ্গা হবে? পুঁজিবাদী অর্থনীতির যত দায় কি শুধুমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর? পুঁজিপতিদের কোনো সামাজিক দায়িত্ব নেই? অর্থাৎ সমাজ, সভ্যতার যাবতীয় শোষণযন্ত্র শ্রমিক শ্রেণীর উপর দিয়েই চলবে!
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এই অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। সবই হয়তো ঠিক কিন্তু প্রশ্ন হল যাঁদের শ্রমের উপর ভিত্তি করে এই উন্নয়ন, এই জিডিপি বৃদ্ধি সেই শ্রমিক শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থার কি কোন উন্নতি হবে? তাহলে এই উদার অর্থনীতি, শ্রমিজীবী মানুষের কি কাজে লাগবে? পুঁজিবাদী অর্থনীতির কি এটাই কাজ শ্রমিকদের শোষণ কর ও পুঁজিনির্ভর সমাজ গঠন কর?
কথায় আছে ‘History repeats itself’ কার্যত আজ আমরা শিল্প বিপ্লবের প্রথম যুগে ফিরে যাচ্ছি যেখানে নাম মাত্র মজুরিতে শ্রমিকদের 14-18 ঘন্টা কাজ করানো হতো। শ্রমিকরা নিজেদের দাবি দাওয়া আদায়ে ‘মে দিবস’ পালন করেছিল। তাই আজ আমাদের মে দিবসকে স্বরণ করে নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। শুধুই মুনাফা কেন্দ্রিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি শ্রমিকদের জীবনে কতটা কুপ্রভাব ফেলে তা ‘চার্লি চ্যাপলিনের’ ‘Modarn Times’ চলচ্চিত্রে খুব সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে। এখানে ‘চার্লি চ্যাপলিন’ একটি কারখানায় ‘যন্ত্রের নাট টাইট’ দেওয়ার কাজ করত, সারাক্ষণ কাজ করার ফলে টিফিনের সময় ও চ্যাপলিনের হাত নাট টাইট দেওয়ার সময় যেমন ঘুরত তেমন ভাবেই ঘুরতে থাকে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষকে কার্যত যন্ত্রে পরিণত করে এটিই তাঁর উৎকৃষ্ট উদাহরণ! চ্যাপলিনের এই সিনেমাটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করে ও সভ্য সমাজের গালে কষাঘাতের সমান!
তাহলে প্রশ্ন হল সভ্যতার উত্তরণের পথ কি?
এখানেই এসে যায় পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈকল্পিক মডেল মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি।সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বলা হয় সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সকলে সমান সুযোগ সুবিধা পাবে। বর্তমান বিশ্বে বঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত মানুষের উত্থানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকল্প নেই, তাহলে প্রশ্ন হল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র ব্যার্থতায় পর্যাভূষিত হল কেন?
এর উত্তরে বলা যায় সমাজতন্ত্রের বহু গুণাবলি থাকলে ও এর বেশি কিছু ত্রুটি লক্ষ্যণীয় সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেও কি সমস্যার সমাধান সম্ভব? ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায় সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেও তার সফলতা নির্ভর করে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা কে পরিচালনা করছে তাঁর উপর। লেনিনের মতো নেতার উত্থান হলে তা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছায়, আবার স্ট্যালিনের মতো কোন নেতার হাতে পৌঁছালে তা একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে। এই একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় যেখানে সর্বহারার শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা সেখানে দেখা যায় কার্যত নতুন ধরণের পার্টি ভিত্তিক শাসন দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ জমিদার ও শোষক শ্রেণীকে সরিয়ে এক পার্টি কেন্দ্রীক নতুন জমিদার শ্রেণীর উত্থান ঘটে। যা বর্তমানে চীনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল না থাকায় সরকারের সমালোচনা করা যায় না এগুলি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল সমস্যা। তবে এখানে একটা কথা উল্লেখ্য সমাজতন্ত্র কিন্তু মিডিয়ার অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের কথা বলে না, ক্ষেত্র বিশেষে সমাজতান্ত্রিক শাসকশ্রেণী এরূপ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।
সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা সহজ হলেও সমাজতান্ত্রিক মনের মানুষ গড়ে তোলা খুব কঠিন! সমাজতন্ত্রে সরকার খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের গুরুদায়িত্ব পালন করে তাই সরকারি খরচে মানুষ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক ইত্যাদি বড় বড় উচ্চ পদে যায় কিন্তু যখন দেশকে সেবা ফেরত দেওয়ার কথা আসে তখন তাঁরা বেঁকে বসে। তখন তাদের মনে হয় আরও অর্থের প্রয়োজন এত কম পয়সায় কাজ করা কিভাবে সম্ভব? আসলে মানব চরিত্র বড়ই জটিল তাঁরা সমষ্টিগত চিন্তার থেকে ব্যাক্তিগত লাভ লোকসানের কথা বেশি ভাবে, ঠিক এই জায়গাতেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি পরাজিত করেছে। একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যায় দুই অর্থনীতির মৌলিক প্রভেদ কোথায়, সোভিয়েত রাশিয়ার একজন শ্রমিক দেখছে সমমর্যাদা সম্পন্ন একজন আমেরিকার শ্রমিকের বাড়িতে কালার টিভি রয়েছে, অথচ তাঁর ঘরে সাদাকালো টিভি! স্বভাবতই এই রাশিয়ান শ্রমিক তাঁর দেশের অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ হচ্ছে এবং মনে মনে আমেরিকার শ্রমিকের বিলাস বৈভব জীবনের স্বপ্ন দেখে কিন্তু সেই শ্রমিক এটা দেখে না রাশিয়ার সকলের ঘরে সাদাকালো টিভি রয়েছে কিন্তু আমেরিকার প্রতিটি শ্রমিকের ঘরে রঙিন টিভি নেই, বহু শ্রমিকের ঘরে কার্যত কোন টিভিই নেই!
আসলে মানুষের চাহিদার কোন শেষ নেই, আরও আরও চাই এর নীতি মানুষকে দুর্নীতি পরায়ণ করে তোলে। ঠিক এই কারণে দেখা যায় বহু রাশিয়ান বৈজ্ঞানিকরা একবার আমেরিকায় গেলে আর সহজে ফিরে আসতে চাইত না টাকার কাছে মেধা বিক্রি হয়ে যেত, অনেকে আবার বলত গনতন্ত্রের অভাবে তারা রাশিয়ায় ফিরতে চাই না। অনেকের মতে কেজিবির মতো গুপ্তচর সংখ্যায় অনেকেই সিআইএর হয়ে কাজ করত। আমলাতন্ত্রের দুনীর্তি দেশকে ভিতর থেকে দুর্বল করে তোলে। এভাবে সোভিয়েত রাশিয়া ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে, স্বাধীন মিডিয়া না থাকার কারণে ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থার ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়েছিল। তাই মিখাইল গর্বাচভ তাঁর গ্লাসনস্ত ও পেরেস্তৌইকা নীতি প্রবর্তন করলে নব্য সমাজতন্ত্রি ও পুরানো সমাজতান্ত্রিদের লড়াইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়।
সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রে জনগণের আর এক অভিযোগ ছিল এইসব দেশে খাদ্যের চরম সংকট দেখা যেত। আসলে সকলকে সমান ভাবে খাদ্য বন্টনের নীতির দরুণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক দেশে খাদ্য সংকট দেখা যেত এগুলি তাদের ব্যার্থতা কিন্তু প্রশ্ন হল তাঁদের উদ্দেশ্যে কি খারাপ ছিল? সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে কেউ যাতে অভুক্ত না থাকে রাষ্ট্র সে ব্যবস্থা নিত। হয়তো সব সময় পেরে উঠত না কিন্তু ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বহু মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেলেও রাষ্ট্রের কি কোন দায় ছিল?
এবার ভারতের মতো দেশের দিকে তাকানো যাক আজ যাঁরা দিন রাত পুঁজিবাদী অর্থনীতির কথা বলেন তাঁদের কাছে প্রশ্ন ভারতে যদি পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম বিকাশ ঘটত তাহলে এই কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের পক্ষে কি বেসরকারি ক্ষেত্রের ব্যয়বহুল শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো জীবনের মৌলিক পরিষেবা গ্রহণ করা সম্ভব হত? ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সরকারি শিক্ষার সুযোগ না পেলে আমার মতো নিম্ন মাধ্যমিক পরিবারের সন্তানদের পক্ষে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হত না। কোটি কোটি মানুষ কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা যেত। বর্তমানে করোনা সময়কালে ও আমরা কি দেখি? মুনাফাকেন্দ্রিক বেসরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্র মানুষকে বাঁচানোর জন্য কি ভূমিকা পালন করছে? জীবন বাঁচানোর জন্য সেই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে কেন?
মুনাফার সময় পুঁজিবাদী অর্থনীতি কার্যকর কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব নেওয়ার সময় এই পুঁজিবাদী অর্থনীতির রূপকারদের দেখা যায় না কেন?
এথেকেই প্রমাণিত হয় পুঁজিবাদী অর্থনীতি শুধু মুনাফার কথা ভাবে কিন্তু মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যা সমাধানে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশেষ কোন ভূমিকা নেই। তাহলে প্রশ্ন হল জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী অর্থনীতি না সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কোনটি বেশি উপযোগী? অথচ সমাজতন্ত্রকে গালি দেওয়া এই লোকগুলিই চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির সুরক্ষা নিতে চাই।
সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বহু ভালো জিনিস থাকলে ও বেশ কিছু খারাপ জিনিস লক্ষ্য করা যায় যেমন- সমাজতান্ত্রিক দলগুলিতে আর এক দোষ দেখা যায়, অনেক সময় এমন নেতাদের উৎপত্তি হয় যাদের বাস্তবের সঙ্গে কোন যোগসূত্র নেই, মানুষের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই। মাটির সঙ্গে যুক্ত না থাকা এমন মানুষ গুলি জনপ্রতিনিধি হলে সমস্যা বৃদ্ধি পায়। মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললে ও গরীব মানুষের প্রয়োজনে পাওয়া যায় না, নিজের পরিচিত বেষ্টনিতেই সীমাবদ্ধ এমন মানুষ আর যাইহোক সমাজের কোন কাজে লাগে না। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত এই ধরনের মানুষের সংখ্যা বেশি এরা সমাজতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু মানুষের সুখে দুঃখে থাকে না। এরা নিজেরা কতকগুলি বই পড়েই সমাজ পরিবর্তন করতে আসে, তাই এই তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সমাজের বিশেষ সম্পর্ক নেই তাই তাঁরা সমাজ বিচ্ছিন্ন। আসল কথা হল যদি প্রকৃতপক্ষে এরা গরীব, কৃষক, শ্রমিকজীবি মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করে কার্যকরি ভূমিকা গ্রহণ করত, তাহলে এই মতাদর্শ এতটা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠত না। তাই কমেরেডদের আত্মসমীক্ষা করা উচিত! তবে এটাও সত্য এতকিছুর পরেও বাম মনোভাবাপন্ন এই সমস্ত মানুষেরা শ্রমিকদের কথা কিছুটা হলেও ভাবে, অন্যদের ক্ষেত্রে তাও দেখা যায় না!
একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন সমাজতন্ত্রকে সমালোচনা করলেই জাতে ওঠা যাবে তাঁদের কাছে প্রশ্ন পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা কতটা পূরণ করে? করোনা মহামারীতে দেখা যায় তুলনা মূলকভাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশগুলি এই মহামারী রূখতে বেশি সফল। অন্যদিকে ট্রাম্পের মতো প্রশাসক ‘ওবামা কেয়ার’ বাদ দেওয়ার কথা বলছে তিনি মনে করেন এটা করের টাকার অপচয়। তা প্রশ্ন হল পুঁজিপতিদের ভর্তুকি দিলে করের টাকার অপচয় নয়, গরীব মানুষদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দিলে তা করের টাকার অপচয়? পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা এটাই যে টাকা থাকলে চিকিৎসা হবে, আর টাকা না থাকলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী! এটাই কি পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বার্থকতা? এই বিপদের দিনে রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব না নেই সাধারণ গরীব মানুষ যাবে কোথায়? আমেরিকাতে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে মৃত মানুষের অধিকাংশ অ্যাফ্রো আমেরিকান কালো ও এশিয় বাদামি চামড়ার মানুষ, সরকারের প্রতি অভিযোগ অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হওয়ার কারণে এদের যথার্থ চিকিৎসা হয়নি।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই নিষ্ঠুরতার চরম নিদর্শন পাওয়া যায় গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। 1929 এর আর্থিক মহামন্দার অন্যতম কারণ ছিল অত্যধিক শ্রমিক শোষণ। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ‘হারবার্ট ক্লার্ক হুভার’ (1929-33) ঘোষণা করেন আমেরিকার সামনে এক অন্তহীন সমৃদ্ধির দিগন্ত উন্মুক্ত, তিনি আমেরিকার জনগণের “প্রতিটি পাত্রে মুরগি এবং প্রতিটি গ্যারেজে দুটি করে গাড়ির” কথা বলেন। এই সময় আমেরিকা সমৃদ্ধির চরম শিখরে পৌঁছায় কিন্তু তাঁর সমৃদ্ধির সবকিছুই বৃহৎ পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই বৃহৎ পুঁজিপতিরা দেশের হাজার হাজার ক্ষুদ্র কোম্পানিকে গ্রাস করে একচেটিয়া ব্যবস্থা গড়ে তোলে, দেশে চরম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এলেও সাধারণ শ্রমিকের জীবনে মৌলিক কোন পরিবর্তন আসেনি, তাঁদের দারিদ্র ও দুর্দশার মধ্যেই কালাতিপাত করতে হত।
1929 এর অর্থনৈতিক মহামন্দার অন্যতম কারণ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভোগ্যপণ্য, খাদ্যশস্য ও শিল্পদ্রব্য রপ্তানি করত এবং এরফলে আমেরিকা অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। যুদ্ধ শেষে ইউরোপীয় দেশগুলি শিল্প উৎপাদন শুরু করলে আমেরিকার রপ্তানি হ্রাস পায়। অত্যধিক লাভের আশায় আমেরিকান শিল্পপতিরা প্রচুর পণ্য উৎপাদন করেছিল, কিন্তু সবটা বিক্রি না হওয়ায় ফলে শিল্পপণ্যের পাহাড় জমতে শুরু করে। এরফলে শিল্পপতিরা উৎপাদন কমিয়ে দেয় ও শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করে, ফলে শ্রমিকরা বেকার হয়ে যায় বাজারে চাহিদার অভাব ঘটে। বাজারে মন্দা আসতে থাকে এবং গুজব রটে বাজারের তেজিভাব শীঘ্রই কমে আসবে। এরফলে 24 শে অক্টোবর, যা ‘কালো বৃহস্পতিবার’ নামে পরিচিত ওই দিন 30 মিলিয়ন শেয়ার বিক্রি হয়। আবার 29 শে অক্টোবর মঙ্গলবার আর ও 13.5 মিলিয়ন শেয়ার হাত বদলায়। শেয়ার বাজারে হাহাকার পড়ে যায়।
লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা বাজারের তেজিভাব দেখে শেয়ার বাজারে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। ব্যাংকগুলি শেয়ার বাজারে বহু অর্থ লগ্নি করেছিল তাঁদের ও বিশাল অর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। মানুষের ধারণা হয় ব্যাংকে টাকা রাখার থেকে বাড়িতে রাখা নিরাপদ। লক্ষ লক্ষ মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে ছোটে, ব্যাংকগুলির কাছে অত টাকা না থাকার কারণে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। 1929-32 এরমধ্যে 5700 টি ব্যাংক ফেল করে ও 3500 টি ব্যাংক তাদের কাজকর্ম বন্ধ রাখে। 1929-1933 সালে আমেরিকায় বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় 14 মিলিয়ন। মাত্র দুই মাসে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা 40,000 মিলিয়ন ডলার হারায়, ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এভাবে ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা’ (World Economic Great Depression) দেখা যায়।
অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে এই মহামন্দা থেকে খুব সহজেই রক্ষা পাওয়া যেত, তেজিভাবের সময় শিল্পপতিদের লাভ ছিল 72% কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে মাত্র 8%। তাই শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমে খুব সহজেই বাজারের তেজিভাব বজায় রাখা যেত কারণ লক্ষ লক্ষ মার্কিন শ্রমিকদের তখনও রেডিও, টিভি, গাড়ি ইত্যাদি ভোগ্যপণ্য ছিল না! অথচ আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয় না। এই মহামন্দা কাঁটাতে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট’ তাঁর ‘নিউ ডিল’ প্রবর্তন করেন এর ফলে তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের কাজের ব্যবস্থা করেন, শ্রমিকদের আট ঘন্টা কাজের ব্যবস্থা করেন এর ফলে বহু নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়, শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন করার অধিকার দেন। কার্যত রুজভেল্টের এই নীতিগুলির ফলেই আমেরিকা ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধির দিকে ফিরে আসে।
অথচ আজ আমরা কি দেখি সরকার 8 ঘন্টার পরিবর্তে 12 ঘন্টার কাজের দিকে ঝুঁকছে এরফলে কর্মের নতুন সুযোগ কমবে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ নতুন করে বেকার হবে। শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস করার ফলে করোনা পরবর্তী মহামন্দা আরও জাঁকিয়ে বসবে। তাই সরকার ও শিল্পপতিদের প্রয়োজন শ্রমিকদের মানুষ হিসাবে গণ্য করা এবং তাঁদের শ্রমসময় হ্রাস ও মজুরি বৃদ্ধি করা। কারণ তাঁদের হাতে অর্থ আসলে তবেই চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, চাহিদা বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে নিয়োগ বৃদ্ধি পাবে, নিয়োগ বৃদ্ধি পেলে খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং খরচ বৃদ্ধি পেলে চাহিদার সৃষ্টি হবে এভাবে অর্থনীতির চাকা গতিপ্রাপ্ত হবে এবং এভাবেই মন্দা থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। এই কারণে কিছু কিছু সমাজতান্ত্রিক দেশে দৈনিক ছয় ঘন্টা করে পাঁচদিন কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বেশ কিছু ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিরা এই দাবিতে আন্দোলন করছে। কারণ তাঁদের দাবি শ্রমিকরা যদি মানসিক দিক থেকে সুস্থ না থাকে তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে না। শ্রমিকরা মানসিক দিক থেকে সুস্থ থাকলেই তাঁরা গঠনমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে, না হলে তাঁরা শ্রমদাসের ন্যায় যন্ত্রমানবে পরিণত হবে। অথচ আমাদের সরকার তাঁর উল্টো নীতি নির্ধারণ করে চরম শ্রমিক শোষণের দিকে এগোচ্ছে, এতে মন্দা আরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই অধিক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা হয়তো দেশের জিডিপি বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে কিন্তু পুঁজির অসম বন্টনের ফলে তা সাধারণ মানুষের বিশেষ কাজে লাগে না, তাই ‘চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্বে’ সমাজের শেষ প্রান্তিক মানুষটির বিশেষ কোন উপকার হয় না। একদিকে সরকার বলছে টাকা নেই দেশের অর্থনীতিকে গতিপ্রদান করতে শ্রমঘন্টা বাড়ানো জরুরি অন্যদিকে এই সরকার এই করোনা মহামারীর সময় পুঁজিপতিদের 68,607 কোটি টাকা ঋণ মুকুব করে, দেশের এই চরম দুর্দিনে ও সরকারকে সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টে 20,000 কোটি টাকা খরচ করতে হবে? দেশের দুর্দিনে শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর জন্য সরকারের কাছে যথেষ্ট অর্থ নেই অথচ প্রধানমন্ত্রীর জন্য জেট প্লেন কিনতে 8,458 কোটি টাকা রয়েছে? এটাই কি ‘সাবকা সাথ, সাবকা বিকাশের’ নমুনা? যদিও পরবর্তীতে চাপে পড়ে সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে করোনা মহামারীর জন্য 200 কোটি টাকার ফান্ড যদিও নিন্দুকেরা বলেই অর্ধেক টাকাই বিজ্ঞাপনে খরচ হয়ে যায়। অথচ ক্লাবে দেওয়ার জন্য 1300 কোটি টাকা খরচ করতে কোন সমস্যা নেই। মেলা, খেলা, মোচ্ছব ইত্যাদি লেগেই রয়েছে অথচ চাকরি, ডিএ প্রদান করতে যথেষ্ট টাকা নেই এটাই হয়তো মা মাটি মানুষের সরকারের উন্নয়নের নমুনা? এটাই হয়তো করোনা নির্মূলে রাজ্যের জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা? রাঘুরাম রাজনের মতো প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এরই মধ্যেই সতর্ক করেছেন করোনার ফলে দেশে প্রায় 14 কোটি মানুষ নতুন করে বেকার হতে পারে। অথচ সরকারের যেন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, সরকার লেগে রয়েছে শ্রমিক শোষণ করতে। পুঁজিপতিদের ঋণ মকুব করতে, জেট প্লেন কিনতে, এক্ষেত্রে টাকার অভাব হয়না? টাকার অভাব হয় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে, শ্রমিকদের ট্রেনে করে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে? পুঁজিপতিদের কোটি কোটি টাকা ঋণ ছাড় দেওয়া হয় আর এদিকে অর্থনীতিকে সচল করার নামে শ্রমজীবী মানুষের শ্রমঘন্টা 8 ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে 12 ঘন্টা করতে হয়, ইহাই কি আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিদর্শন?
অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুফল হিসাবে সস্তায় শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যের সুযোগ পাওয়ার ফলে গরীব মানুষগুলি প্রকৃত জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারে, সমাজতন্ত্রের এই দান ভোলার নয়, তবে সমাজতন্ত্রের আলোকে যেন স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধে আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রই হয়তো আপামর গরীব, শোষিত মানুষের পক্ষে অধিক যুক্তিযুক্ত হবে।
সমাজতান্ত্রিক দলের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ তাঁরা এক বিশেষ ধর্মের মানুষকে তোষণ করে। এখানে উল্লেখ্য প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক দেশে যেভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়ানো হয় তা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নারীরা স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। যেমন- সোভিয়েত রাশিয়া, নাজিবুল্লার আফগানিস্তান ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রথম মহাকাশে অভিযান প্রেরণ করেছিল এবং ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা প্রথম সোভিয়েত নারী যিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন। তাই বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও নারী স্বাধীনতায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরাট ভূমিকা ছিল।
এখন প্রশ্ন হল ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের বামেদের ভূমিকা কি রকম? এখানে বহুক্ষেত্রই দেখা যায় তাঁরা এক বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়কে তোষণ করছে। এখানে বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ্য তাঁদের এই তোষণ নীতি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয় কিন্তু আমরা যে সমাজে বসবাস করি সেই সমাজ থেকেই তাঁরা প্রতিনিধিত্ব পায়।
তাই সংসদীয় গণতন্ত্রে অনেক সময় তাঁদের ধর্মীয় বিষয়ে আপস করতে হয়, কারণ ধর্মীয় বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়া আমাদের মত দেশে অনেক ক্ষেত্রেই বেশ কঠিন। তবে তাঁর মানে এই নয় ধর্মের তোষামোদি করব এবং মানুষকে ধর্মের দিকে দীক্ষিত করব, পারিপাশ্বিক অবস্থা বিচারে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও দলতন্ত্রের মধ্যে দুরত্ব বজায় রাখায় সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ। তাই সমাজের ভেতর থেকে সংস্কার হওয়া প্রয়োজন, মুক্তচিন্তার ব্যাপক প্রসারের ফলেই এরূপ সমাজব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব!
সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন তাই কোন একটি বিষয়ের দিকে বিশ্লেষণ করে সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদ সফল কি ব্যার্থ তা বিচার করা যথার্থ হবে না! তবে এটা সত্য সৃষ্টির আদি থেকে আজও শাসক ও শোষিতের এই লড়াই চলছে। তাই প্রয়োজন শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম করা। তাই আজ নতুন করে যখন শ্রমজীবী মানুষের উপর অত্যাচার নেমে আসছে তখন ‘মে দিবস’ আজ আরও প্রাসঙ্গিক। মে দিবসের আদর্শে দীক্ষিত হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকদের এক হওয়া প্রয়োজন, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এই শ্লোগান বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন। কৃষক, শ্রমিক সহ মেহনতি মানুষেরা যেন তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে! আশাবাদী শ্রমিকজীবি মানুষের এই অধিকারের লড়াই তাদের নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা যোগাবে। সভ্যতার চাকা যাদের পরিশ্রমে ঘুরে চলে, তাঁরা যেন আগামী দিনে মানবিক মানুষের জীবন পায় সেটাই আশা রাখি!
তথ্যসূত্র:-
1. গণশক্তি।
2. আধুনিক ভারত ও বিশ্ব- জীবন মুখোপাধ্যায়।
3. মধ্যযুগ থেকে ইউরোপের আধুনিকতায় উত্তরণ- নির্মলচন্দ্র দত্ত।
4. আধুনিক ইউরোপ (ফরাসি বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ১৭৮৯-১৯৪৫)- সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।
5. বুদ্ধিজীবীর নোটবই- সম্পাদক সুধীর চক্রবর্তী।
( ক্যাপিটালিজম- অভ্র ঘোষ, সোশ্যালিজম- অভ্র ঘোষ, বুর্জোয়া- অমিয়কুমার বাগচী, প্রলেতারিয়েত- অমিয়কুমার বাগচী।)
6. The Hindu.
- https://www.thehindu.com/opinion/lead/pathways-to-a-more-resilient-economy/article31512646.ece
- https://www.thehindu.com/opinion/op-ed/boost-wages-to-stimulate-indias-growth/article31512239.ece
- https://www.thehindu.com/opinion/lead/equal-freedom-and-forced-labour/article31560930.ece
7. News click.
- https://www.newsclick.in/West-Bengal-TMC-Govt-Spent-1%2C300-Crore-Clubs-While-Unemployment-Continues-Rise
- https://www.newsclick.in/game-keeping-workers-poor
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ