বিশেষ প্রতিবেদক: পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভারতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। আজ শনিবার এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। পাশাপাশি দৈনিক মৃত্যুও আড়াই হাজার ছাড়িয়েছে এই প্রথমবার। অক্সিজেনের অভাবে দেশটির প্রায় সবকয়টি রাজ্যে বাড়ছে মৃত্যুর হার। এমন পরিস্থিতিতে চীনের সাহায্যে মন নেই ভারতীয় নেতাদের। আর তাই দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি চিন্তার ভাঁজ ফেলছে দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক করোনা পরিস্থিতির উপর।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমিত হয়েছেন ৩ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭৮৬ জন। সবমিলিয়ে গত বছর থেকে এখনও অবধি আক্রান্ত হলেন ১ কোটি ৬৬ লক্ষ ১০ হাজার ৪৮১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যায় নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। শনিবার ২ হাজার ৬২৪ মৃত্যু হওয়ায় দেশে এখনও অবধি প্রাণ হারালেন ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ৫৪৪ জন।
এদিকে অক্সিজেনের অভাবে ফের মৃত্যুর ঘটনা দিল্লিতে। সেখানকার জয়পুর গোল্ডেন হাসপাতালে শুক্রবার রাতে ২০ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে অক্সিজেনের অভাবে।
জয়পুর মেডিক্যাল হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডি কে বালুজা বলেন, ‘সরকারের তরফে আমাদের হাসপাতালের জন্য ৩.৫ মেট্রিক টন অক্সিজেন বরাদ্দ করা হয়েছে। সেই অক্সিজেন শুক্রবার বিকাল ৫টার মধ্যে আসার কথা ছিল। কিন্তু তা এসে পৌঁছয় মধ্যরাতে। ততক্ষণে ২০ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে।’
এর আগে দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ২৫ জন রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছিল। দিল্লির অধিকাংশ হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাব প্রকট।
অক্সিজেন সমস্যা সমাধানে চীনের সাহায্য নিতে ভারতের অনীহা
করোনার উচ্চ সংক্রমণে বিপর্যস্ত ভারত। দেশটিতে চলছে ভয়াবহ মেডিক্যাল অক্সিজেনের সংকট। অক্সিজেনের অভাবে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এমন বিপর্যয়ের মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতের দিকে।
ইতিমধ্যে ভারত বাইরের দেশ থেকে অক্সিজেন আমদানি করবে বলে গত সপ্তাহে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
সূত্র মতে, ভারত যে দেশগুলো থেকে অক্সিজেন আমদানি করতে চাচ্ছে তাদের মধ্যে চীন নেই।
এদিকে চীন জানিয়েছে, তারা ভারতের কোভিড নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও সহায়তা প্রদানে প্রস্তুত।
সূত্র মতে, বৃহস্পতিবার ভারতের কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে কোভিডকে সমগ্র বিশ্বের জন্য শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বলা হয়, করোনা চিকিৎসায় ভারত যেসব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা সমাধানে সাহায্য করতে চায় চীন।
গত বছরও ভারত চীন থেকে মেডিক্যাল সরঞ্জাম ক্রয় করেছে। তবে এগুলো সবই ছিল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে কোভিডের ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে ভারত ও চীন উভয় রাষ্ট্রই।
টিকার সংকটে ভারত
এদিকে ভারতের নতুন সংক্রমণের অর্ধেকেরও বেশি ধরা পড়ছে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে। সেখানে টিকাদান কর্মসূচি থমকে গেছে প্রায়।
কিছুদিন আগে পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যদি তিন দিনের মধ্যে নতুন টিকা এসে না পৌঁছায়, আমাদের পুরো টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে হবে।
তবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন বলেন, টিকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তা একেবারেই ভিত্তিহীন।
তিনি দাবি করন, চার কোটির বেশি টিকার ডোজ এখনও মজুদ আছে বা সরবরাহ করা হচ্ছে।
তবে দিল্লি ভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংক, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ওম্মেন সি কুরিয়ান বলছে, কোন কোন রাজ্যে আসলেই টিকার সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যেসব রাজ্য দ্রুত টিকা দেয়ার কাজটি করতে পেরেছিল।
কুরিয়ান বলেন, ভারতের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা যতটুকু বলে দাবি করে, তার সঙ্গে প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতার হয়তো একটা ফারাক আছে। এই সংকটের শুরুটা হয়তো সেখান থেকে।
ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কেরালা এখন অক্সিজেনে স্বয়ংসম্পূর্ণ
গত বছরের করোনা অতিমারি থেকেই শিক্ষা নিয়েছিল কেরালা৷ তাই বেশির ভাগ রাজ্যই যখন অক্সিজেন পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, কেরালা তখন স্বাবলম্বী৷ কারণ গত বছর এপ্রিল মাসে যেখানে কেরালায় মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯৯.৩৯ মেট্রিক টন, সেখানে এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ২১৯ মেট্রিক টন৷
গত বছর গোটা ভারতের মতো করোনার প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়েছিল কেরালাতেও৷ আর তখন থেকেই মেডিক্যাল অক্সিজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মজুত করার পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করেছিল দেশটির দক্ষিণের এই রাজ্যটি৷
গত বছর কেরালায় প্রতি মিনিটে অক্সিজেন উৎপাদন হত ৫০ লিটার করে৷ বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে প্রতি মিনিটে ১২৫০ লিটার৷ গত বছরের ২৩ মার্চ থেকে কেরালার স্বাস্থ্য দফতর এবং গোটা দেশে অক্সিজেন সরবরাহের পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা কেন্দ্রীয় এজেন্সি পেসোর পরিকল্পনার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে৷
সূত্র মতে, বিপিসিএল-এর কোচি পরিশোধনাগার থেকেই করোনার সময় যখন অক্সিজেনের চাহিদা তুঙ্গে ছিল তখন ২ মেট্রিক টন পর্যন্ত অক্সিজেন পাওয়া গিয়েছে৷ এবারেও তারা কেরালার সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহে তৈরি৷
একই ভাবে পালাক্কাড়ে আইনক্স প্ল্যান্টের ১৪৯ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে৷ কেরালা মিনারেলস অ্যান্ড মেটালস লিমিটেড গত নভেম্বর মাস থেকে অক্সিজেন উৎপাদন করছে৷ সেখান থেকেও ৭ মেট্রিক টন অক্সিজেন পায় কেরালা৷
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেন, আমরা কেরালার চিকিৎসা ক্ষেত্রের পরিকাঠামো অনেকটাই বাড়িয়ে নিতে পেরেছি৷ এই মুহূর্তে আমাদের রাজ্যে অক্সিজেনের চাহিদা ৭৪.২৫ মেট্রিক টন৷ আর আমরা ২১৯.২২ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদন করছি৷ সব সরকারি হাসপাতালে কোভিড এবং সাধারণ রোগীদের জন্য মোট যে আইসিইউ বেড আছে, তার ৫০ শতাংশই এখনও খালি রয়েছে৷
সূত্র মতে, এই মুহূর্তে কেরালাের ৩২টি হাসপাতালে ২ থেকে ৩০ মেট্রিক টন অক্সিজেন একসঙ্গে মজুত করে রাখার পরিকাঠামো রয়েছে৷ জরুরি প্রয়োজনে কোচিন শিপইয়ার্ড থেকেও অক্সিজেন পাওয়া সম্ভব৷ সেখানেও ২০ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদিত হয়৷
গত দু’ তিন দিনে অক্সিজেনের চাহিদা কিছুটা বাড়লেও তাই সমস্যায় পড়েনি কেরালা৷ উল্টে সেখান থেকে তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে৷
বাংলাদেশ থেকে রেমডেসিভির কিনতে চায় ঝাড়খণ্ড
করোনা মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার ডোজ রেমডেসিভির আমদানির জন্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করেছেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন।
গত ১৯ শে এপ্রিল টুইটার বার্তায় মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বলেন, ‘ঝাড়খণ্ডে আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকা রোগীদের জন্যে রেমডেসিভিরের চাহিদা বেড়ে গেছে এবং এটি পাওয়া যাচ্ছে না বলে আমরা জরুরি ব্যবহারের জন্যে ৫০ হাজার শিশি কিনতে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। যত দ্রুত সম্ভব আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্যে আমি (কেন্দ্রীয় মন্ত্রী) ডিভি সদানন্দ গৌড়ের কাছে চিঠি লিখেছি।’
চিঠিতে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, রাজ্যটিতে ৭৬ হাজার ৬৪০ ডোজ করোনা ভ্যাকসিনের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে মাত্র আট হাজার ৩৮ ডোজ।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কাছ থেকে ৫০ হাজার শিশি রেমডেসিভিরের দরপত্র পেয়েছি। এর দাম পড়বে ১০ লাখ ডলার।’
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ‘আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু পাইনি। কেউ একজন আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে (ওষুধের) রপ্তানি মূল্য সম্পর্কে জেনেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাকে বলেছি যে রপ্তানির জন্যে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণের রেমডেসিভির নেই, তাই এটি সরবরাহ করতে সময় লাগবে।’
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঝাড়খণ্ডে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত এক লাখ ৬২ হাজার ৯৪৫ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বর্তমানে আক্রান্ত রয়েছেন ২৮ হাজার ১০ জন। আর এখন পর্যন্ত রাজ্যটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক হাজার ৪৫৬ জন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ