পুরান ঢাকার আরমানিটোলা খেলার মাঠ সংলগ্ন একটি ছয়তলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, শুক্রবার ভোররাত সোয়া তিনটার দিকে ওই ভবনে আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এপর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে, আহত ২৩ জন। এদিকে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া হবে বলে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও আবারও অগ্নিকাণ্ড ঘটায় নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অগ্নিকাণ্ড
রাজধানীর পুরান ঢাকায় আরমানিটোলায় ছয়তলা একটি ভবনের নিচতলায় কেমিক্যালের গোডাউনে আগুনে অন্তত চার জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২৩ জন। তাদেরকে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, আগুন লাগার পর পর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ভবনের নিচতলা। ধীরে ধীরে ধোঁয়া উঠতে থাকে ওপরের দিকে। এতে ওপরের তলার বাসিন্দারা আগুনের বিষয়টি টের পান। এ সময় মানুষজন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও ধোঁয়া ও আগুনের কারণে বের হতে পারেনি। তারা ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। তবে ভবনের ছাদ তালাবদ্ধ থাকায় কেউ ওপরে উঠতে পারেননি। বিভিন্ন ফ্লোরে আটকে থাকা লোকজন চিৎকার করতে থাকেন। আটকে পড়া বাসিন্দারা বারান্দা ও জানালা থেকে মোবাইলের আলো জ্বেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান ঘটনাস্থল থেকে বিবিসিকে বলেন, নিহতের মধ্যে একজন নারী এবং একজন পুরুষ। নারী ঐ ভবনের বাসিন্দা এবং পুরুষটি ভবনের নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন।
বাকি দুইজনের মরদেহ দুপুরে উদ্ধারকাজের সময় পাওয়া গেছে।
হাফিজুর রহমান বলেন, ভবনটির নিচতলায় রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। হাজী মুসা ম্যানসন নামে ঐ ভবনের নিচতলা থেকে শুক্রবার ভোর রাত সাড়ে তিনটা দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, ভোররাত সোয়া তিনটার আগুন লাগে। ১৯টি ইউনিট তিন ঘণ্টার চেষ্টার পর আজ সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে।
জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ধোঁয়ার কারণেই বেশির ভাগ মানুষ অসুস্থ হয়েছেন। আহতেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দুই থেকে তিনজন চিকিৎসাধীন।
অগ্নিকাণ্ড তদন্তে চার সদস্যের কমিটি
আরমানিটোলায় কেমিক্যালের গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রাসেল শিকদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ডিডি নূর হাসানকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে ডিএডি বজলুর রশিদকে।
এছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে দু’জন ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর রয়েছেন। এই তদন্ত কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। খবর বাসসের
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আব্দুল হালিম জানান, তদন্ত কমিটি আগুন লাগার কারণ এবং ভবনের অনুমোদন সংক্রান্ত বিষয়গুলো যাচাই করবে।
কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত
কেমিক্যাল গোডাউন থেকে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার ভবনটিতে আগুন লাগে বলে মনে করছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, ভবনের নিচতলার মার্কেটে ১৬ থেকে ২০টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে রাসায়নিক পণ্য কেনাবেচা হতো। ভবনের নিচতলার পেছনের দিকের একটি রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে মনে করছে পুলিশ।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত উপকমিশনার কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ভবনটির নিচতলায় দোকান রয়েছে। এসব দোকানে রাসায়নিক পণ্য বিক্রি হতো। রাসায়নিক পণ্য বিক্রির কোনো দোকানের গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে তারা মনে করছেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ভবনের নিচতলায় পেছনের দিকে বেশ কয়েকটি দোকানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনটির নিচতলার ৫–৬টি দোকান আগুনে প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে। দোকান ও গুদামের ভেতরে বড় বড় ড্রামগুলো পুড়ে গেছে। এ ছাড়া রাসায়নিক পণ্য কেনাবেচায় ব্যবহৃত কিছু ছোট ছোট কনটেইনারও দেখা গেছে।
কেমিক্যাল গোডাউন নিয়ে প্রশ্ন
২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মো. ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ওই বছরের ১৫ জুন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সে প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড রোধে ১৭টি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, পুরান ঢাকাসহ আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক পদার্থের কোনো গুদাম বা দোকান না রাখা। এছাড়া পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশের সুবিধার কথা মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভবন নির্মাণ এবং অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছিল। রাসায়নিক ও এসিড জাতীয় দাহ্য পদার্থের দোকান ও বিক্রির সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আরো সতর্ক থাকা, প্রয়োজনে এসব দাহ্য পদার্থ বিক্রি ও রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা শিল্প এলাকা স্থাপন এবং অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে পুরান ঢাকায় ওয়াসার লাইনে দমকল বাহিনীর জন্য ‘হাইড্রেন্ট পয়েন্ট’ রাখার কথাও সুপারিশে ছিল।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় পারফিউমের ফ্যাক্টরি ও গোডাউনে অগ্নিদুর্ঘটনায় ৭১ জন প্রাণ হারান। এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জন প্রাণ হারান। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর সরকারের পক্ষ থেকে আবারও একই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
তবে সেসবের সুপারিশের সবগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলেই আবারও অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, ওই ভবনের নিচে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। তাদের দাবি, আশপাশের প্রায় সব ভবনেই এ ধরনের গুদাম রয়েছে।আর কত মৃত্যু হলে আবাসিক ভবনগুলোতে রাসায়নিকের গুদাম সরানো হবে- এ প্রশ্ন পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের।
তারা বলেন, প্রত্যেক বছরই কোনো না কোনো ভবনে এই রাসায়নিক গুদাম থেকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এই রাসায়নিক গুদাম থেকে।ওইসব ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে আবাসিক ভবনে রাসায়নিক গুদাম বা দোকান স্থাপনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে তা আজও দেখা যাচ্ছে না।
তাদের মতে, ‘এই অগ্নিকাণ্ডের দায় গোটা ব্যবস্থার। নিমতলীর ঘটনার পর সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর কয়টা বাস্তবায়ন হয়েছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এসব দাহ্য পদার্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। প্রশ্ন হলো, ফিরে যেন না আসতে পারে সেটা দেখবে কে?’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১২৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ