অল্প দূরেই হাতিরঝিলের কাকচক্ষু জল। হাওয়ার হাত ধরে জলের গন্ধ ছড়িয়ে আছে আশপাশে। এদিকে দেয়াল জুড়ে সিনেমার চরিত্র। আবহটা প্রথাগত রেস্তোরাঁর থেকে বেশ ভিন্ন। এই ভিন্নতার স্বাদ নিতে আপনাকে যেতে হবে ‘ঝিল কুটুম’। রাজধানীর গুলশান ১-এর পুলিশ প্লাজা থেকে হাতিরঝিলের রাস্তা ধরে রামপুরার দিকে যেতে হাতিরঝিল আইল্যান্ডে ঢোকার মুখেই পেয়ে যাবেন রুচিশীল এই রেস্তোরাঁ। ঢাকার ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করতে ঝিল কুটুমের জুড়ি নেই। দেয়ালজুড়ে দেশি বিদেশি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের পোস্টার আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। আড্ডায়, গানে, খাবারের স্বাদে, ঘ্রাণে অভ্যস্ত জীবনের বাইরে দারুণ কিছু সময়ের কাটাতে পারবেন। তবে শুধু খাবারের স্বাদে, আড্ডায়, গানে নয় ‘ঝিল কুটুম’ মানুষের ঠোঁটে লেগে আছে আরও কিছু কারণে।
এই সিনেক্যাফেটি নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আলোচিত সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’-এর সেন্সর অনুমতি না পাওয়া নিয়ে নিজেদের বানানো ‘প্রতিবাদী টি-শার্ট’ ক্যাম্পেইন করেছিল। এছাড়া কাস্টমারসহ যেকারও জন্যই ‘ঝিল কুটুম’ ফ্রিতে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করে থাকে। পিরিয়ডকালীন সময়ে কোন নারীর স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রয়োজন হলে, তা সে কাস্টমার হোক বা না হোক, ঝিল কুটুম ফ্রিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের সুবিধা দেয়। আর ঝিল কুটুম-ই বাংলাদেশের প্রথম রেস্তোরাঁ, যারা এই ধরনের একটি উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রথম শুরুটা যেভাবে
স্যানিটারি ন্যাপকিনে আমরা এখনও অভ্যস্ত হতে পারিনি। স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গিয়ে সংকোচে ভোগেন নারীরা। দোকানিরা ন্যাপকিন এমনভাবে কাগজে মুড়িয়ে দেন, যাতে সেটি দেখা না যায়। অনেকেই এটিকে গোপনীয় বিষয় মনে করেন। কিন্তু নারীদের পিরিয়ড যেমন স্বাভাবিক, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারও অতোটাই স্বাভাবিক। এই অস্বাভবিক চোখে দেখা, এই সঙ্কোচের জন্য এখনও অনেক অঞ্চলে নারীরা ন্যাপকিন ব্যবহার না করে অস্বাস্থ্যকর কাপড় বা অন্য জিনিসপত্র ব্যবহার করেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন নারীরা।
‘ঝিল কুটুম’ রেস্তোরাঁর মালিক আনন্দ কুটুম ঠিক এই জায়গাটা থেকেই বের হতে চেয়েছেন। এই অসঙ্কোচ অস্বস্তির জায়গা থেকে সাধারণ ব্যাপারটাকে সাধারণভাবে দেখতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে স্টেট ওয়াচকে আনন্দ কুটুম জানান রেস্তোরাঁয় স্যানিটারি ন্যাপিকিন রাখাকে তিনি কোন ইনোভেটিভ আইডিয়া বলে মনে করেন না। একটি রেস্তোরাঁ কাস্টমারদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যে যে ব্যবস্থা নেয়, তার মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিনের খুব স্বাভাবিকভাবেই থাকার কথা।
তিনি স্টেট ওয়াচকে বলেন, আমরা আসলে রেস্তোরাঁটাকে পরিবেশ বান্ধব, কাস্টমার বান্ধব করতে চেয়েছি। সেখান থেকে যখন হেলথ এন্ড স্যানিটাইজিং নিয়ে ভাবলাম, তখনই স্যানিটারি ন্যাপকিনের কথাটা মাথায় আসে। গত বছর সম্ভবত সেপ্টেম্বর থেকে এই উদ্যোগটা কার্যকর করা হয়।
তিনি বলেন, এখানে আমাদের প্রচুর মহিলা কাস্টমার আসে। আর হাতিরঝিল এমন একটা জায়গা, যেখানে সামান্য বৃষ্টি আসলে, দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই। স্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট নেই। আর যেটা আছে, সেটাও বন্ধ থাকে প্রায়ই। তাই শুধুমাত্র টয়লেট ব্যবহার করতে আমাদের রেস্তোরাঁয় প্রচুর মানুষ আসে। তো এমন অনেকেই আসে যাদের ওই সময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রয়োজন। এমন চিন্তা থেকেই স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা শুরু। যাতে সে কাস্টমার হোক বা না হোক, তার প্রয়োজন পড়লে সে যেন এই সেবাটা নিতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা বেশ খোলামেলাভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন রেখেছি। যাতে এটি পুরুষ নারী উভয়ের কাছেই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যেহেতু স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে বাংলাদেশে অলরেডি একটা ট্যাবু গড়ে উঠেছে। তাই এই অতি সাধারণ ব্যাপারটাকে আমরা সাধারণভাবেই দেখাতে চেয়েছি।
কেমন ছিল মানুষের প্রতিক্রিয়া?
পিরিয়ড স্যানিটারি প্যাড এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খুব স্বাভাবিক হলেও আমাদের দেশের খুব কম সংখ্যক মেয়েই এই বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারে। এমনকি নিজের মায়ের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে অনেকেই। শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। গ্রামে তো এটাকে অচ্ছুৎ হিসেবে ঘোষণা করা হয় প্রায়ই। পিরিয়ড চলাকালীন শুভ কাজে তার অংশ নেওয়া নিষেধ।
শহরে যে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন এসেছে তা নয়। ঋতুচক্রকে মেয়েলি বিষয় হিসেবে গণ্য করে এর ওপর আরোপ করা হয় অযাচিত লজ্জা। একে গোপনীয়তার মোড়কে আবৃত করে রাখা হয়। আর এর ফলে লাখ লাখ নারী বিভিন্ন রোগে ভোগে। এতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ঝিল কুটুমের পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসনীয়।
এদিকে এমন উদ্যোগে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট মনে হল আনন্দ কুটুমকে। তিনি এ প্রসঙ্গে স্টেট ওয়াচকে বলেন, আমরা ধারণা করিনি এতো মানুষ এই উদ্যোগটাকে সহজ ও সুন্দরভাবে গ্রহণ করবে। আমাদের একটাই কমন টয়লেট। টয়লেটেই স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা থাকে। সপ্তাহে দুই প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন আমাদের প্রয়োজন পড়ে। এটা আমারে প্রত্যাশার বেশি। আমরা ভেবেছিলাম একটা প্যাকেটে হয়তো দুইমাস চলে যাবে। তবে জানি না, মানুষ প্রকৃতপক্ষেই এটি ব্যবহার করে কিনা। তবে ব্যবহার করলে আমাদের উদ্যোগ সফল হবে।
তবে কিছু প্রতিবন্ধকতা, কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে ঝিল কুটুমকেও। এ বিষয়ে আনন্দ কুটুম বলেন, বিভিন্ন মানসিকতার মানুষ থাকে। আমাদের টয়লেট একটি থাকায়, অনেক পুরুষ কাস্টমার আলাদা টয়লেট করার কথা বলেন। এতো খোলামেলাভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা নিয়ে সরাসরি না হলেও আপত্তি জানাতে চায়। তবে আমাদের সাধারণ একটা ব্যাখ্যা থাকে। সেটা হলো যেহেতু এটা কমন টয়লেট, নারী পুরুষ উভয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সেখানে থাকবে। আপনার স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রয়োজন হলে আপনিও নিতে পারেন।
এছাড়া তিনি বলেন, কিছু মানুষ এই উদ্যোগটাকে মার্কেটিং স্ট্রাটেজি হিসেবে নিচ্ছে। অনেক মেয়েও এই অভিযোগ করেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে বলেছে, কাস্টমার টানার জন্য এটা করেছি। তবে আগেই বলেছি এই সেবা শুধুমাত্র কাস্টমারদের জন্য নয়। তারপরেও যদি এটাকে আমাদের মার্কেটিং স্ট্রাটেজি বলা হয়, তবে তাই। আমি কাস্টমার বৃদ্ধির জন্য যদি রেস্তোরাঁ সাজাতে পারি, অন্যান্য সুবিধা দিতে পারি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে পারি, তাহলে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখলে অসুবিধা কোথায়!
তিনি আরও বলেন, তবে প্রথম আমার যে ব্যাপারটা মাথায় এসেছিল, তা হল নারী স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। এই ব্যাপারটাকে ইগনোর করা যাবে না। তাহলে পুরো দেশ ভুগবে। তাই নারী স্বাস্থ্য প্রায়োরিটি লিস্টে আগে রাখতে হবে। তবে আমার একার পক্ষে তেমন কিছু করা সম্ভব নয়। আমার জায়গা থেকে যেটুকু সম্ভব, সেটা করছি শুধু।
এখানেও প্রতিবন্ধকতা স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম
বেশি দাম ও সচেতনতার অভাবে দেশের ৮০ শতাংশ নারী পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারেন না। ফলে, নানা ধরনের স্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়ছেন নারীরা। স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে অনিয়মিত ব্যবহারকারীসহ মোট ১৪ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতেন। এখন ব্যবহার করেন ২০ শতাংশ। এর প্রধান কারণ স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চমূল্য। আনন্দ কুটুমের কথাতেও ছিল একই সুর।
এমন প্রচেষ্টার পরিধি আরও বাড়ানোর প্রসঙ্গে স্টেট ওয়াচকে আনন্দ কুটুম বলেন, আমাদের পক্ষে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব হয় না। ঝিল কুটুম রেস্তোরাঁটা ‘বি’ ক্যাটাগরির। একটা ট্যুরিস্ট প্লেসে হলেও কাস্টমার খুব বেশি নয়। এছাড়া করোনা তো পেছনে লেগেই আছে। সপ্তাহে দুই প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন লাগে আমাদের। খরচ হয় ৫০০ টাকা। মাসে দু’হাজার টাকা। আলাদাভাবে হয়তো টাকাটা খুব বেশি না। তবে আমাদের আরও অনেক খাতে ব্যয় আছে, তাই এই খরচটা আমাদের জন্য বেশ ডিফিকাল্ট হয়ে যায়। তবে কোন কোম্পানি যেমন, মায়া বা সেনোরা তাদের প্রমোশনের জন্য কিছু প্রোডাক্ট আমাদের এখানে রাখতে পারে বা বুথ করতে পারে।
আনন্দ কুটুম বলেন, আমাদের দেখাদেখি এখন আরও অনেক রেস্টুরেন্ট এই উদ্যোগ নিয়েছে। এটা আমাদের জন্য আনন্দের। দেশে আমরা প্রথম এই উদ্যোগটা নিয়েছিলাম। মানুষ সেটা পছন্দ করেছে। আরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আমাদের এক পরিচিতার রেস্টুরেন্ট ‘হেক্সা ডাইন’ এবং ‘উনুন’ এই উদ্যোগ নিয়েছে। কিছুদিন আগে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ সড়কের কাছে ‘টেরাকোটা’ নামের একটি রেস্তোরাঁয় এই উদ্যোগটি নেয়। খুলনার কিছু রেস্টুরেন্টেও এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা যেহেতু প্রথম এই ইনিশিয়েটিভ নিয়েছিলাম, অনেকেই আমাদের দেখে উদ্যোগটা নিচ্ছে। আমি অনেককে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানিয়েছি এই উদ্যোগ নিতে। ব্যাপারটা আমরা শুরু করার পর, অনেকে পজিটিভলি নিচ্ছে, ইমপ্লিমেন্ট করছে, এটা আমাদের জন্য আনন্দের।
প্রসঙ্গত, কর্মজীবী নারী বা শিক্ষার্থী বা যে কেউ, যাদের বাইরে বের হতে হয়, তাদের অনেকেরই বাইরে থাকাকালীন মাসিক শুরু হওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। অনেক সময় কাজ শেষ না করেই ফিরে আসতে হয়েছে। আবার অনেকের নিয়মিত মাসিক হলেও প্রস্তুতি ছাড়া বাইরে বের হয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে স্বস্তি দিতে বিনা মূল্যে রেস্তোরাঁয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের এই সুবিধা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে ন্যাপকিন সেবা নেওয়ার জন্য রেস্তোরাঁয় খাওয়াও বাধ্যতামূলক নয়। নারীরা শুধু নিজেদের প্রয়োজনে রেস্তোরাঁয় ঢুকবেন, ওয়াশরুমে যাবেন, ন্যাপকিন সুবিধা নিতে পারবেন। ঝিল কুটুমের হাত ধরে দেশে এই উদ্যোগের শুরু। ঝিল কুটুম রেস্তোরাঁর মালিক এই স্বপ্ন দেখেন, দেশের প্রতিটি রেস্টুরেন্টে নারীরা এই সেবা যেন নিতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫০৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ