মুজিব রহমান
মানব ইতিহাসে সবচাইতে বড় আবিষ্কার হচ্ছে আগুনের আবিষ্কার। মানুষ দেখতো বনে আগুন লাগলে, তাদের সাথে অন্য পশুরাও দৌড়াচ্ছে বাঁচার জন্য। ফিরে এসে দেখতো পোড়া গাছপালা বা পালাতে না পারা কোন মরা পশু পুড়ে আছে। এই প্রলয়ঙ্করী আগুন- দেবতা না হয়ে যায় না। গ্রিক পুরান অনুসারে আগুনের দেবতা হলেন হেফেস্টাস। হেফেস্টোস জিউস ও হেরার পুত্র। পুরাকালে আগুনকে বিশ্বের সবকিছু সৃষ্টির একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে ধরা হতো। পৃথিবী জুড়ে ছিল অগ্নি উপাসক, ইসলাম আসার আগে আরবেও ছিল অগ্নিপুজারী। আমরা অগ্নি উপাসক হিসাবে চিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধীকে। অগ্নি উপাসকদের কাছে আগুন হচ্ছে সূর্যের পার্থিব প্রতিভূ। আমরা ছোট সময় একটা সুল্লক বলতাম- লাল গরু বন খায়, জল খেয়ে মারা যায়। বলেন তো এটা কি? এই সুল্লকটাও মানুষের আদি বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। এর উত্তর আমরা জানি- ‘আগুন’।
হিন্দু পুরান মতে অগ্নি দেবতা হলো মানুষ ও অন্যান্য দেবতাদের মধ্যে সংযোগ সাধনকারী দেবতা। দেবতাদের মধ্যে একমাত্র অগ্নিই দৃশ্যমান। তাই হিন্দুদের বিয়েতে অগ্নিমন্ত্র পাঠ ও আগুনকে বিয়ের সাক্ষী রাখা হয়। মৃতের সৎকার শেষেও অগ্নি স্পর্শ করে শুদ্ধ হয়ে গৃহে প্রবেশ করতে হয়। মৃতদেহও অগ্নি দেবতার কাছে উৎসর্গ করা হয়। আগে অগ্নিপূজায় নরবলির বিধান ছিল। এর পরিবর্তে গো-মহিষাদি বলির বিধান আসলো। কৃষিকাজে গো-মহিষের সংকট তীব্র হওয়ায় ছাগ বলির বিধান দেয়া হয়। আগুন আর ছাগলের একটি মিল আছে, দুটোই সর্বভুক। সেই থেকে অগ্নি দেবতার বাহনও ছাগল। মানুষ এখন বুঝে নিয়েছে আগুন আসলে কোন দেবতা নয়। তাই সূর্য বা আগুন পূজা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
ইসলাম ধর্ম মতে জীনরা হলো আগুনের তৈরি। আর জাহান্নামে পাপীদের আগুনে নিক্ষেপ করে শাস্তি দেয়া হবে। তবে আগুন নিভানোর একটি দোয়ার কথা আমরা জানি, সেটা হলো তাকবির দেয়া। তাকবির দিলে আগুন নিভে যাবে। তাকবির হলো- আল্লাহু আকবার (আল্লাহ মহান)। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, আগুন যত প্রলয়ঙ্করী হোক, তাকবিরের মাধ্যমে তা নিভে যায়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত তাবরানি হাদিস নং ১/৩০৭।
আগুন একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রকাশ মাত্র। বিক্রিয়া চলমান থাকলে অগ্নিশিখা উৎপন্ন হয় আর ওটুকুই আমরা দেখে থাকি। এসিডের বিক্রিয়ায় যখন পুড়তে থাকে তখন অগ্নিশিখা উৎপন্ন হয় না, কিন্তু তাপ উৎপন্ন হয়। আগুন ও তাপের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আজ মানব সভ্যতা এ পর্যায়ে আসতে পারতো না। আমরা বিভিন্ন রকম শিখা দেখি। এখন মানুষ যা পোড়ানো হবে তার উপাদান ও অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে আগুনের তীব্রতা ও রঙ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অধিক উত্তপ্ত হলে গ্যাস আয়নিত হয়ে প্লাজমা উৎপাদন করতে পারে। যেমন সূর্য প্রধানত প্লাজমা তথা আয়নিত পদার্থ দিয়ে গঠিত। অগ্নিশিখায় আমরা মূলত কার্বনডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের উপস্থিতিই দেখি।
যে আগুন দেখে মানুষ পালিয়ে যেত দূরে, এখনো পশুপাখি পালিয়ে যায় সেই আগুনকেই বিজ্ঞানের সহায়তায় মানুষ ঘরে বোতল বন্দি করে রেখেছে। অর্থাৎ বোতল ভরা গ্যাস থেকে আমরা তাপ উৎপন্ন করছি রান্নায় বা শিল্পে। বিশ্বজুড়েই একসময় সূর্যকে দেবতা মনে করে পূজা করা হতো। সেই সূর্যে আসলে কি আছে? কিছুই না প্রায় সবটুকুতেই রয়েছে হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম যা আয়নিত অবস্থায় রয়েছে। সূর্য কেন্দ্রভাগে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অবিরাম হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপাদন করে যাচ্ছে। কেন্দ্রে সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ৬২ কোটি মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পোড়ায়। আর সেই বিক্রিয়ার প্রচণ্ড তাপের সামান্য অংশ পৃথিবীর প্রাণিকূলকে টিকিয়ে রেখেছে। অগ্রসর মানুষ আজ সূর্য সম্পর্কে পুরাণ/মীথ ও প্রাচীন গ্রন্থের ভ্রান্ত ধারণা অতিক্রম করেছে। তারা বুঝেছে সূর্য আমাদের ছায়াপথের একটি নক্ষত্র মাত্র। কোন দেবতা নয়, পূজনীয় কিছু নয়, অবিরাম এক বিক্রিয়ার ফল। তবুও এখনো বহু মানুষ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ মানুষ সূর্য ও আগুন সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে বসে আছেন।
আপনার মতামত জানানঃ