দশ বছরের ছোট্ট এক ছেলেশিশু। তাকে রমজানের প্রথম দিন মাদ্রাসার একটি কক্ষে ধর্ষণ করেছে তারই শিক্ষক নজরুল ইসলাম। এরপর ঘটনা ধামাচাপা দিতে চলে নানা কূটকৌশল। ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে দেন-দরবার করে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য ও প্রিন্সিপাল বিষয়টি মিটমাট করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। মাদ্রাসার ভাবমূর্তি রক্ষার কথা বলে বিষয়টি যাতে পুলিশ পর্যন্ত না পৌঁছায়, সেটি নিশ্চিত করতেও চেষ্টা চালানো হয়।
ঘটনার তিন দিন পর গত শনিবার (১৭ এপ্রিল) মাদ্রাসার ভেতরেই সালিশের আয়োজন করা হয়। ওষুধ-মলম ও তার সঙ্গে পাঁচ-সাত হাজার টাকার বিনিময়ে ঘটনাটি চেপে যাওয়ার ‘রায়’ দেয় সালিশ আয়োজকরা। তবে এরই মধ্যে খবরটি পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সালিশ থেকেই শনিবার অভিযুক্ত শিক্ষক নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে নরসিংদীর মাধবদী থানা পুলিশ। গতকাল রোববার শিশুটির মেডিকেল পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে।
শিশুটির বাবা পেশায় একজন অটোরিকশাচালক। ছেলের সঙ্গে ঘটা ঘটনা নিয়ে কথা বলার সময় তার গলা ভারি হয়ে আসছিল। তিনি জানান, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার তার। পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন নরসিংদীর মাধবদীতে। ১০ বছরের ছোট্ট ছেলেটি পড়াশোনা করছে স্থানীয় শিমুলেরকান্দি দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার হেফজ বিভাগে। আরেক ছেলে পড়াশোনা করছে স্থানীয় একটি স্কুলে। বেশ কিছুদিন ধরে তার ছোট্ট সন্তান জ্বরে ভুগছে। এরই মধ্যে রমজানের প্রথম দিন গত ১৪ এপ্রিল সকালে মাদ্রাসার শিক্ষক নজরুল ইসলাম তার স্ত্রীর মোবাইলে ফোন করেন। ছেলেকে মাদ্রাসায় পাঠাতে জোরাজুরি করেন।
শিশুটির বাবা আরও জানান, ছেলেকে মাদ্রাসায় পাঠানোর কথা বললে তার স্ত্রী শিক্ষককে জানিয়ে দেন ছেলে অসুস্থ। এরপরও নাছোড়বান্দার মতো আচরণ করেন তিনি। ওই শিক্ষক তার মাকে বলেন, অসুস্থ হলে প্রয়োজনে ‘পানি-পড়া’ দেওয়া হবে। তাকে যেন মাদ্রাসায় পাঠানো হয়।
শিশুটির বাবা আরও বলেন, ছেলে আমার কাছে কোনোমতে মাদ্রাসায় ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে পেরেছিল। ভয়ার্ত ও কাতর কণ্ঠে ছেলে জানায়, বড় ভাই তাকে রেখে চলে আসার পর বন্ধ মাদ্রাসার একটি নির্জন কক্ষে শিক্ষক নজরুল ইসলাম তার সঙ্গে ‘খারাপ কাজ’ করেছে। যন্ত্রণায় কাতর হলেও মাদ্রাসা শিক্ষকের বর্বরতা থেকে তার মুক্তি মেলেনি। কিছু সময় পর দেখে তার শরীর রক্তে ভিজে গেছে। তিনি বলেন, ‘ছেলের এমন রক্ত ভেজা শরীর দেখে স্থির থাকতে পারিনি।
ঘটনার পরপরই বাঁশের লাঠি নিয়ে ছেলের মা ও আমি কুলাঙ্গারটাকে শায়েস্তা করতে মাদ্রাসায় ছুটে যাই। আমাদের বাড়ি থেকে মাদ্রাসা খুব বেশি দূরে নয়। কারও কাছ থেকে খবর পেয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুল হান্নান ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির কয়েকজন ঘটনাস্থলে এসে হাজির হন। ঘটনাটি আমাদের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন ততক্ষণে জেনে যায়। তারাও মাদ্রাসায় এসে জড়ো হয়। এরপর একটি কক্ষে শিক্ষক নজরুলকে আটক করে রাখি। এরই মধ্যে বারবার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বলতে থাকেন, যেন বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশি হট্টগোল না করি। তিনি মিটমাট করে দেবেন। বেশি জানাজানি হলে মাদ্রাসার ইমেজ নষ্ট হবে।’
অটোরিকশাচালক আরও বলেন, কুলাঙ্গারের বিচার দাবিতে যখন মাদ্রাসায় এমন হট্টগোল চলছিল এরই মধ্যে জোহরের নামাজের সময় হয়ে যায়। ওই শিক্ষককে কক্ষে আটকে সবাই মসজিদে নামাজ পড়তে চলে যাই। নামাজ শেষে কক্ষের সামনে এসে দেখি, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক ভেতরে নেই। অধ্যক্ষের কাছে নজরুলের সন্ধান চাইলে তিনি আমাদের মাথা গরম না করার পরামর্শ দেন। পরে জানতে পারি, কক্ষের সামনে তালা দেওয়ার পর পেছনের জানালা দিয়ে হেফাজত নেতা নজরুলকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন অধ্যক্ষ নিজেই। এরপর সেই অধ্যক্ষ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বলেন, পরদিন বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানে আমাদের ডাকা হবে।
শিশুটির বাবা আরও বলেন, অনেক চাপ ও মিথ্যা প্রবোধ দেওয়ার পর শনিবার মাদ্রাসায় সালিশ বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, অধ্যক্ষ, অভিযুক্ত শিক্ষকসহ আরও অনেকে উপস্থিত হন। তারা ছেলের চিকিৎসার জন্য ওষুধ ও মলম কিনে দেওয়া এবং সঙ্গে খুব সামান্য কিছু টাকা নিয়ে বিষয়টি চেপে যেতে বলেন। সালিশের নামে যখন এটাকে নিয়ে চরম প্রহসন করার আয়োজন চলছিল, তখনই হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির হয়। বৈঠকের মাঝ থেকেই নজরুলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় তারা। এতে পণ্ড হয় সালিশ।
শিশুটির বাবা আরও বলেন, শুরু থেকে ধর্ষণের এই ঘটনা যারা ধামাচাপা দিতে দেনদরবার করছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় মিজান চৌধুরী, মহসিন শিকদার, রেনু মুন্সী, সিরাজ প্রধান, লিল মিয়া, বাবুলসহ কয়েকজন।
শিমুলেরকান্দি দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলেন, ‘আমরা বলেছি একটি দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, এটা সত্য। এটি সামাজিকভাবে মিটমাট করে দেওয়ার চিন্তা করেছিলাম। চিকিৎসার খরচ লাগলে সেটা দেওয়ার কথাও বলেছি।’
নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, শিশুটির সঙ্গে যা হয়েছে, সেটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। ওই শিক্ষক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
মাধবদী থানার ওসি সৈয়দুজ্জামান বলেন, পুলিশ যথাসময়ে ঘটনাস্থলে না গেলে এমন জঘন্য ঘটনা আড়ালেই থাকত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের এই মামলার তদন্তও দ্রুত শেষ করা হবে।
এ ব্যাপারে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করে তাকে পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৮৩০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ