দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার ভূ-বেষ্টিত পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানে ২০০১ সালে বিমান হামলার মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা করেছিল। প্রায় ২০ বছর পর তার অবসান চাইছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশটি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই আফগানিস্তান থেকে সব সেনা সরাতে চায় বাইডেন প্রশাসন।
১১ সেপ্টেম্বর তারিখটিও এখানে উল্লেখযোগ্য। কারণ ঠিক ২০ বছর আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে আল-কায়দার হামলার পর প্রতিশোধ নিতে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী। উৎখাত করা হয় ওই সময়ে আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারকে।
আফগান যুদ্ধের কারণে এখন পর্যন্ত প্রাণহানি হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির। অন্যদিকে ২০ বছর ধরে ক্রমাগত চাপ পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারেও। শুধু এ যুদ্ধ চালাতে গিয়েই গত ২০ বছরে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
আফগান যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ও বোস্টন ইউনিভার্সিটির পারডি সেন্টারের এক যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। দ্য কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট শীর্ষক এক প্রকল্পের অধীনে এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় অনুযায়ী শুক্রবার এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, এ যুদ্ধে জীবন ও সম্পদের হানি হয়েছে অনেক। এখন পর্যন্ত এ যুদ্ধে প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আফগান ও পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক রয়েছে ৭১ হাজার ৩৪৪ জন। দেশ দুটির নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মারা গিয়েছে ৭৮ হাজার ৩১৪ জন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৪৪২ সৈন্য ও প্রতিরক্ষা বিভাগের ছয় বেসামরিক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। মার্কিন বাহিনীর সামরিক ঠিকাদার মারা গিয়েছে ৩ হাজার ৯৩৬ জন। যুদ্ধে মার্কিন মিত্র অন্যান্য দেশের ১ হাজার ১৪৪ জন সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ নিহত হয়েছে ৮৪ হাজার ১৯১ জন।
এছাড়া এ যুদ্ধ চলাকালে ১৩৬ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী এবং ৫৪৯ জন মানবাধিকারকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, এ তালিকায় শুধু যুদ্ধকালীন সহিংসতায় মৃতদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে যুদ্ধসৃষ্ট খাদ্য ও পানীয়র অভাব, অবকাঠামো ধ্বংস, রোগব্যাধি ইত্যাদিসহ পরোক্ষ প্রভাবে মৃতদের এ তালিকায় আনা হয়নি। বেশ কয়েকটি প্রাথমিক উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।
এতো গেলো প্রাণহানির হিসাব। যুদ্ধে অর্থের অপচয়ও হয়েছে যুক্তির হিসাব না মেনে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।
এ হিসাব অনুযায়ী, এ যুদ্ধের পেছনে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতি বাংলাদেশের মোট জিডিপির কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে এ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় আঞ্চলিক বৃহৎ দেশ ভারতের এক বছরের মোট জিডিপির কাছাকাছি।
প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ২৫৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। অন্যদিকে ভারতের অর্থনীতির আকার ছিল প্রায় ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ। সে হিসাবে শুধু এ যুদ্ধ চালাতে গিয়েই গত ২০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সাড়ে সাত গুণ অর্থ খরচ করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক ছিলেন বোস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নেটা ক্রফোর্ড। তার ভাষ্যমতে, এ যুদ্ধ চালাতে গিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগকে শুধু আফগানিস্তানেই ব্যয় করতে হয়েছে ৯০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। যুদ্ধের খরচ নিরূপণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এ ব্যয়কে শুধু ‘আইসবার্গের উপরিভাগই’ বলা চলে।
প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, শুধু এ যুদ্ধের সহায়ক ঘাঁটিগুলো পরিচালনা করতে গিয়েই পেন্টাগনের ব্যয় হয়েছে ৪৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এছাড়া যুদ্ধফেরত ও আহতদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা বাবদ ২৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, ঋণের সুদ হিসেবে ৫৩ হাজার কোটি এবং পররাষ্ট্র বিভাগের মাধ্যমে ৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।
নেটা ক্রফোর্ডের বক্তব্য, আফগানিস্তান যুদ্ধের মূল্য শুধু এসবেই সীমাবদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ পাকিস্তানেও ছড়িয়েছে। বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থী হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। সামরিক-বেসামরিক প্রাণ ও মার্কিন যুদ্ধফেরতদের সেবার প্রয়োজনীয়তাকেও এর মধ্যে ধরতে হবে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে: এসব কী আসলেও ন্যায়সঙ্গত ছিল?
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১, এই পাঁচ বছরে চতুর নেতা ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে শক্তঘাঁটি গেড়ে বসেছিল আল-কায়দা। তারা সেখানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বানিয়েছে। এমনকি কুকুরের উপর বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে দলে ভিড়িয়েছে এবং তাদের এক একজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হিসেবে গড়ে তুলেছে।
১৯৯৮ সালে আল-কায়দা কেনিয়া ও তানজানিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হামলা চালিয়ে ২২৪ জনকে হত্যা করে। নিহতদের বেশিরভাগই আফ্রিকার সাধারণ মানুষ। ওই সময়ে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আল-কায়দা সেখান থেকে সক্রিয়ভাবে বিশ্বজুড়ে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে থাকে। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান।
যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় তাদের আরব মিত্র সৌদি আরবের মাধ্যমে তালেবান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আফগানিস্তান থেকে আল-কায়দা জঙ্গিদের উৎখাতের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তালেবান সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে আল-কায়দার হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে দায়ীদের তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল। কিন্তু সেবারও তালেবান ওই প্রস্তাব অস্বীকার করে। তার পরের কয়েকমাসে আফগানিস্তানে তালেবান বিরোধী বাহিনী ‘দ্য নর্দান অ্যালায়েন্স’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনীর সহায়তায় কাবুলে হামলা চালিয়ে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। আল-কায়দা জঙ্গিরা পাকিস্তান সীমান্তে পালিয়ে যায়।
এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, তারপর আফগানিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হামলার আর কোনো পরিকল্পনা সফল হয়নি। সেক্ষেত্রে বলা যায়, দেশটিতে পশ্চিমা সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছে।
যদিও এটা অবশ্যই খুব স্থুলভাবে বিবেচনা করলে। কারণ, সেখানে যুদ্ধে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যুদ্ধে সেখানে সামরিক এবং বেসামরিক উভয় পক্ষকেই অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে। ২০ বছর হতে চলেছে, এখনো আফগানিস্তানে শান্তি ফেরেনি। গবেষক দল ‘অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স’ গ্রুপের তথ্য মতে, ২০২০ সালেও বিস্ফোরণে সবচেয়ে বেশি মানুষ আগানিস্তানে নিহত হয়েছেন।
আল-কায়দা, ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা অন্যান্য জঙ্গিদলের কোনোটিই সম্পূর্ণ নির্মূল হয়নি। পশ্চিমা বাহিনীর বাকি সদস্যরা চলে গেলে দেশটিতে তাদের পুনরুত্থান হবে।
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা নিক কার্টার বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানে এমন একটি নাগরিক সমাজ তৈরি করেছে যারা তালেবান কী ধরনের জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে তাদের বৈধতা চায় তার হিসাব পাল্টে দিয়েছে। দেশটি এখন ২০০১ সালের তুলনায় ভালো স্থানে পরিণত হয়েছে এবং তালেবান এখন আগের তুলনায় অনেক উদার হয়েছে। কার্টার নিজে বেশ কয়েকবার আফগানিস্তান সফর করেছেন।
তবে অনেক বেশি হতাশার কথা বলেছেন এশিয়া প্যাসেফিক ফাউন্ডেশনের ড. সজ্জন গোহেল। তিনি বলেন, সেখানে এখন সত্যিকারের উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আফগানিস্তান আবারও নব্বইয়ের দশকের মত চরমপন্থিদের কারণে রক্তাক্ত ভূমিতে পরিণত হতে পারে।
এখন নানা দেশ থেকে জঙ্গিরা আবারও আফগানিস্তানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য যেতে পারবে। কিন্তু পশ্চিমারা এটার বিরুদ্ধে আর কিচ্ছু করতে পারবে না। কারণ, এরইমধ্যে তারা আফগানিস্তানকে পরিত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
পশ্চিমা নানা গোয়েন্দা সংস্থাও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে হয়তো এটাই আফগানিস্তানের অনিবার্য পরিণতি নয়। বরং দেশটির ভবিষ্যত অনেক কিছুর উপর নির্ভর করছে।
এদিকে, আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে কাতারের দোহায় আফগান সরকার ও তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তিও হয়েছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী তালেবান আবারও আফগানিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে।
তাই অনেক কিছু নির্ভর করছে শেষ পর্যন্ত জিতে যাওয়া তালেবানের উপর। প্রথমত, ক্ষমতায় ফিরে যেতে পারলে তারা কী আবারও আল-কায়দা ও আইএস জঙ্গিদের আফগানিস্তানে সক্রিয় হওয়ার এবং এলাকা দখল করার অনুমতি দেবে। দ্বিতীয়ত, যে চুক্তির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে সেটার কতখানি বাস্তবায়ন হবে। যে চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তানে না থেকেও পশ্চিমবিশ্ব দেশটির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখার পরিকল্পনা করেছে।
তাই বলা যায়, আফগানিস্তানের ভবিষ্যত নিরাপত্তা চিত্র এখনো অস্বচ্ছ।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬২০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ