স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নয়, এমন নীতিতেই দীর্ঘদিন চলছিল আরব দেশগুলো। কিন্তু সেই নীতি থেকে অনেকটা সরে এসেছে তারা। ফিলিস্তিনের বুকে আঘাত হেনে মুসলিম দেশগুলো একে একে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিশর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের বন্দরে নোঙর ফেলেছে। এবার সেই তালিকায় যোগ হবার আগ্রহ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব। সৌদ আরব ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকের চুক্তি হলে তা এই অঞ্চলের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনবে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ। তবে এরকম একটি সম্ভাব্য চুক্তি শান্তি প্রক্রিয়ার অগ্রগতির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে বলে জানান তিনি। গত বৃহস্পতিবার(১ মার্চ) বার্তা সংস্থা সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
বৃহস্পতিবার সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী বলেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে এই অঞ্চলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে তা সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলের ব্যাপক উপকার করবে।’
তিনি বলেন, ‘এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত উপকারী হবে।’
তবে তিনি এও বলেন, ‘এটি কেবলমাত্র সম্ভব যদি ১৯৬৭ এর সীমান্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র দেয়া হয়।’
সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এর আগেও এ ধরনের মন্তব্য এসেছে। গত বছর ডিসেম্বরে সৌদি প্রিন্স ফয়সাল বলেন, ‘যা আমাদের করা দরকার তা হলো একটি শান্তি চুক্তি যার মাধ্যমে মর্যাদার সঙ্গে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হস্তান্তর করা হবে এবং একটি কার্যকর সার্বভৌমত্ব যা ফিলিস্তিনিরা গ্রহণ করবে।’
তিনি তখন বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের লক্ষ্যের অংশ হিসেবে রয়েছে।
এর আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গোপনে সৌদি আরব সফর করেছেন বলে ইসরায়েলের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
ইসরায়েলি নেতা নেতানিয়াহু সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে বিবিসি’র এক প্রতিবেদনা বলা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো পক্ষই এখনো এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেনি।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফর হিসাবে এই ঘটনাকে আন্তর্জতিক মিডিয়া বেশ গুরুত্বের সাথে দেখছে। ওই বৈঠকে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ছিলেন বলে ওয়াশিংটন পোস্ট খবর প্রকাশ করেছে।
এদিকে ইসরায়েলি সরকারী সূত্রের উদ্বৃতি দিয়ে দেশটির জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম হারেৎজ বলছে, এই সফরের ব্যাপারে ইসরায়েলের বিকল্প প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও অন্ধকারে ছিলেন।
একটি টুইট বার্তায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এই বৈঠকটি হয়েছে বলে আভাস দিলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পক্ষই এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি।
ইসরায়েলি সংবাদ মাধ্যমে ওয়াইনেটের বরাত দিয়ে দি ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, সৌদি আরবের উপকূলীয় শহর নিওমে রবিবার বিকালের দিকে কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই সময় তার সঙ্গে ইসরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ এর প্রধান ইয়োসি কোহেন ছিলেন। সেখানে তিনি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও-র সঙ্গে বৈঠক করেন।
হারেৎজ-এর খবরে প্রকাশ, বিমান চলাচলের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েল থেকে একটি বিমান সরাসরি সৌদি মেগা-সিটি নিওমে গিয়েছে। পাঁচ ঘণ্টা পরে সেটা আবার ফেরত এসেছে।
অনেকদিন ধরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চেষ্টা করছে যাতে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর পর ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসিত ফিলিস্তিনে গজিয়ে ওঠে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। পশ্চিমা বিশ্বের বানানো এ রাষ্ট্রকে কখনো মেনে নেয়নি আরবরা। ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও সবশেষ ১৯৭৩ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ হয় পশ্চিমা মদদপুষ্ট রাষ্ট্রটির। এরপর থেকে ইহুদিদের কাছে জমি হারাতে থাকে ফিলিস্তিনিরা। বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ–সমালোচনার মুখে পশ্চিমাঘেঁষা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দুই রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সংঘাত মেটানোর চেষ্টা করে। অবশ্য তা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নয়, এমন নীতিতেই দীর্ঘদিন চলছিল আরব দেশগুলো। কিন্তু সেই নীতি থেকে অনেকটা হঠাৎ করেই সরে আসে তারা। ফিলিস্তিনের কর্মকর্তারা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াকে পেছন থেকে ছুরি মারার সঙ্গে তুলনা করেন।
আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আরব দেশগুলো প্রধান তিনটি শর্ত দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় আরব দেশগুলোর দখল করা জমি ছেড়ে দেওয়া, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের গঠন ও স্বীকৃতি এবং ফিলিস্তিনিদের কাছে দখল করা জমির হস্তান্তর—এ তিন শর্তের কোনোটাও পূরণ হয়নি। তারপরও রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে আরব দেশগুলো।
আরব বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে মিসর। ১৯৯৪ সালে একই পথ অনুসরণ করে জর্ডান।
গত বছরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিতে সই করে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন। পরে এই তালিকায় যোগ দেয় সুদান এবং মরক্কোও।
তবে শুরু থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের নিন্দা জানিয়ে আসছে ফিলিস্তিন। ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে উল্লেখ করে এর তীব্র সমালোচনা করেছে তারা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে বা করতে রাজি হয়েছে, এর সব কটি ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। সম্পর্কের বিনিময়ে সুদানকে সন্ত্রাসবাদের কালো তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েলের সঙ্গে একের পর আরব দেশের সম্পর্ক জোড়া লাগুক না কেন, বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বহু দূরেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বৃহত্তর এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা ইসরায়েল–ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের বিষয়টি। স্বাভাবিকভাবে, ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, এখন তা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। ইসরায়েলের সঙ্গে যেসব আরব দেশের অতীতে যুদ্ধ হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই এসব চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। আবার অনেক মুসলিম দেশ বিরোধিতা করে এগুলোকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দিয়েছে।
মুসলিম দেশগুলোর এই বিভক্ত অবস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। দিজ উইক ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এসব চুক্তি মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করবে, লড়াইয়ের মুখোমুখি করে তুলবে ও ইসরায়েলের আগুনে তেল ঢালবে।’ এই চুক্তি ইসরায়েলের অবস্থান আরও শক্তিশালী ও ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের অধীন করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধপরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হওয়াই যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
এদিকে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া, আরব দেশগুলো যা করছে, তা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ইসরায়েলের সঙ্গে আমিরাতের চুক্তি সইয়ের পরপরই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আমিরাত থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরে আসার নির্দেশ দেন।
ফিলিস্তিনিদের ভয়, এভাবে একের পর এক দেশ তেল আবিবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুললে ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্যান-আরব অঞ্চলের এতদিনকার শক্ত অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, লাভের মধু ইসরায়েলেরই বেশি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বা সামরিক—যেটাই হোক না কেন। আরবদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে আনাটা ইসরায়েলের জন্য বড় সাফল্যই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ