অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগে রক্তে জমাট বাঁধাসহ মৃত্যুবরণের অভিযোগে ইউরোপের অনেক দেশই করোনার এ টিকা প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অবশেষে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে ইউরোপ আবারও অক্সফোর্ডের টিকা প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। ইউরোপের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাকে নিরাপদ ও কার্যকর বলে সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ দেশগুলো আবারও এই টিকা প্রয়োগ শুরু করেছে বলে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে।
রক্ত জমাট বাধার শঙ্কায় ইইউ-এর ১৩টি দেশ এই টিকা প্রয়োগ বাতিল করে। পরে ইউরোপীয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ) টিকাটি পরীক্ষা করে দেখতে পায় এর সঙ্গে রক্তে জমাট বাধার ঝুঁকির কোনও সম্ভাবনা নাই। পরে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন জানিয়েছে তারা টিকাটি আবারও প্রয়োগ শুরু করবে।
প্রায় ৩০টি ঘটনা তদন্তের পর ইএমএ বলেছে, অক্সফোর্ডের টিকার সঙ্গে রক্ত জমাট বাধার উচ্চঝুঁকির কোনো সম্পর্ক নেই।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক এমার কুক বৃহস্পতিবার বলেন, এ টিকা নিরাপদ ও কার্যকর। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে এটি মানুষকে রক্ষা করতে সক্ষম। এই টিকার উপকারিতা অনেক।
এক টুইটে সংস্থাটি জানায়, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণের কারণে তাদের দেহেই রক্ত জমাটের ঘটনা ঘটেছে যাদের রক্তে প্লাটিলেট কম। যদিও এই ঘটনা বিরল। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা ও উপকারিতা অনেক বেশি। তাই এই টিকা কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে।
এর পরপরই জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ এ টিকার প্রয়োগ আবারও শুরু করবে বলে জানায়।
যুক্তরাজ্যের গবেষকদের পর ইউরোপীয় ওষুধ সংস্থার কাছ থেকেও আশ্বাস পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জার্মানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা আজ শুক্রবার(১৯ মার্চ) সকাল থেকেই অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান কর্মসূচি আবারও শুরু করবে।
জার্মান স্বাস্থ্যবিভাগের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ১৬ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি মানুষকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়া হয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন মেডিসিন এজেন্সি-ইএমএর অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে এ টিকার প্রয়োগ শুরু হয়।
অক্সফোর্ডের টিকার প্রয়োগ আবার শুরু করার কথা উল্লেখ করে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জ্য ক্যাসটেক্স জানিয়েছেন, তিনি শুক্রবার বিকেলে এই টিকা নেবেন।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘির বলেছেন, তার দেশও যত দ্রুত সম্ভব বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে চায়। এ টিকার প্রয়োগ ফের শুরু করা হবে। স্পেনও এই টিকার প্রয়োগ শুরু করার বিষয়টি মূল্যায়ন করছে। সাইপ্রাস, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়াও অক্সফোর্ডের টিকার প্রয়োগ শুরু করবে। অবশ্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে সুইডেন।
স্পেন বলেছে, তারা এই টিকার প্রয়োগ শুরু করার বিষয়টি মূল্যায়ন করছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার এ টিকার প্রয়োগ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে ইউরোপে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচির গতি অনেকখানি শ্লথ করেছে; সরবরাহের ঘাটতিও এতে প্রভাব ফেলেছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউরোপের অনেক অংশেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
টিকাটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে শুক্রবার তাদের একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনও প্রকাশ করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এই টিকার নিরাপত্তা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন নাকচ করেছেন। বরিস জানিয়েছেন, তিনি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা নেবেন।
যুক্তরাজ্যের নামকরা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা পিএলসি যৌথভাবে এই টিকা উদ্ভাবন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই টিকার প্রয়োগ চলছে।
টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রক্ত জমাটের খবর প্রকাশ হওয়ার পর যুক্তরাজ্য-সুইডেনভিত্তিক বহুজাতিক জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাদের উদ্ভাবিত টিকার কারণে রক্ত জমাট বাধা বেড়ে যায় এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছিল, যুক্তরাজ্য ও ইইউভুক্ত দেশের ১ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ এ টিকা নিয়েছে। ৮ মার্চের দিকে এদের মধ্যে কেবল ৩৭ জন ব্যক্তি রক্ত জমাটের কথা বলেছেন। যে পরিমাণ মানুষ এ টিকা নিয়েছে, সে তুলনায় এ সংখ্যা নিতান্তই কম।
প্রতিষ্ঠানটি বলেন, ‘মহামারিতে বিচ্ছিন্ন প্রতিটি ঘটনার ওপর এখন নজর অনেক বেশি এবং মানুষের নিরাপত্তার জন্য অনুমোদিত টিকার প্রতিক্রিয়ার ওপরও স্বাভাবিক। প্রচলিত নজরদারির চেয়ে অনেক বেশি নজরদারি হচ্ছে।’
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড নামে উৎপাদন করছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। আর এ টিকার প্রয়োগ চলছে বাংলাদেশেও। ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই টিকা নেয়ার পর রক্ত জমাটের খবর আসলেও ঢাকা থেকে বলা হয়েছে, এই টিকার প্রয়োগ চালিয়ে যাবে তারা।
করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডব ঠেকিয়ে বিশ্বজুড়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরাতে ইতিহাসের বৃহত্তম টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম চলছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের করোনা ট্র্যাকার বলছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১২৬টি দেশের ৩৮ কোটি ১০ লাখ মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৪৭
আপনার মতামত জানানঃ