আসিফ সিদ্দিকী : দেশে বছরে ২৩ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়; যার শুধু আমদানি মূল্যই সাত হাজার কোটি টাকা। এসব চিনি কারখানায় পরিশোধন হয়ে যখন বাজারে বিক্রি হয় তখন বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশের শীর্ষ পাঁচটি শিল্পগ্রুপ চিনির এই বিশাল বাজারের বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে।
চিনি আমদানি এবং পরিশোধনে শীর্ষে আছে সিটি গ্রুপ। দিনে পাঁচ হাজার টন উৎপাদন সক্ষমতার দেশের সবচেয়ে বড় পরিশোধন কারখানাও আছে তাদের। এর পরের স্থানে আছে মেঘনা গ্রুপ; তাদের সক্ষমতা দিনে তিন হাজার টন। তৃতীয় স্থানে আছে চট্টগ্রামভিত্তিক টি কে গ্রুপ। আর খুব কম সময়ে উৎপাদনে এসে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বসুন্ধরা গ্রুপ।
জানা গেছে, অপরিশোধিত চিনি আমদানির বাইরে পরিশোধিত চিনিও আমদানি হচ্ছে দেশে কিন্তু তা খুবই সীমিত পরিসরে। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই মূলত ওষুধ তৈরিতে এই পরিশোধিত চিনি ব্যবহার করছে। আর কিছু চিনি ব্যবহৃত হচ্ছে নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠানে। এর বাইরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চিনি কারখানায় বছরে এক লাখ টনের মতো চিনি উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় আখ মাড়াই করেই এসব চিনি উৎপাদিত হয়। ফলে চিনির বাজারে আমদানীকৃত অপরিশোধিত চিনির ওপরই বাংলাদেশ পুরোপুরি নির্ভরশীল বলা যায়। এই আমদানি নির্ভরশীলতা প্রতিবছরই বাড়ছে।
সিটি গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে আখের উৎপাদন কমে গেছে; সেই সঙ্গে আখ থেকে চিনি উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পড়ছে বলেই আমদানি নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এখানে জোর করে চিনি আমদানি বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বাজারে চাহিদা তৈরি হয়েছে; সেই চাহিদা মেটাতেও বেসরকারি কারখানাগুলো উৎপাদনসক্ষমতা বাড়িয়েছে। আমাদের চাহিদা ১৫ লাখ টন কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা তার দ্বিগুণ। ভবিষ্যতের চাহিদা বিবেচনায় নিয়েই বাড়তি বিনিয়োগে এই সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
চিনি আমদানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে অপরিশোধিত চিনি আমদানির প্রায় পুরোটাই আমদানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে; খোলা জাহাজে (বাল্ক) করে। বিভিন্ন দেশ থেকে বড় শিল্পগ্রুপগুলো নিজেদের জাহাজেই এসব অপরিশোধিত চিনি নিয়ে আসে। কনটেইনারে অপরিশোধিত চিনি আনার কোনো তথ্য নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছার পর বড় জাহাজ থেকে এসব অপরিশোধিত চিনি ছোট জাহাজে স্থানান্তর করে নদীপথে নিজেদের কারখানায় নিয়ে খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে চিনি খালাস করে সড়কপথে নেওয়ার খুব একটা রেকর্ড নেই। অর্থাৎ আমদানীকৃত চিনির পুরোটাই নদীপথে ছোট জাহাজে পরিবহন করা হচ্ছে।
সঠিক হিসাব না পেলেও ধরে নেওয়া হয়, দেশে চিনির চাহিদা বছরে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে মাত্র ৬০-৮০ হাজার টন চিনি উৎপাদন করছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ১৫টি চিনিকল। বাকি চিনির চাহিদার পুরোটাই জোগান দেয় বেসরকারি পরিশোধন কারখানা। দেশের বেসরকারি শিল্পগ্রুপগুলোর অধীনে কারখানায় পরিশোধন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে বছরে ৩২ লাখ টন। কিন্তু চাহিদা আছে ১৬ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার দ্বিগুণ পরিশোধন সক্ষমতা তৈরি করে রাখা হয়েছে আগেভাগেই।
এস আলম গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ১০ হাজার কোটি টাকার চিনির বাজার ধরতে ব্যবসায়ীরা আধুনিক সব পরিশোধন কারখানা গড়ে তুলেছেন। এখানে এককভাবে কারো দাম বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ নেই। বাজারে এত বেশি প্রতিযোগিতা আছে; এখানে মান খারাপ তো প্রশ্নই আসে না। দাম এক টাকা বাড়লেই ক্রেতা হারানোর শঙ্কা থাকে। ফলে খুবই সতর্কতার সঙ্গে আগাতে হচ্ছে।
“সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে”
দাম না পেয়ে আখচাষে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে, সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২১ লাখ ৫৯ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ২৩ লাখ ১৩ হাজার টন চিনি। কাস্টমসের হিসাবে শুধু এর আমদানি মূল্য দাঁড়ায় সাত হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি চিনি আমদানি হয়েছিল ২০১৮ সালে ২৬ লাখ টন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএ পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছর ২০২০ সালে চিনি আমদানির পরিমাণ দুই লাখ টন কমতে পারে। তাদের হিসাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশে চিনি আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে ২২ লাখ ৩০ হাজার টন; ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ২৯ হাজার টন। তবে আগামী বছর ২০২১ সালে দেশে চিনি আমদানি বেড়ে ২৫ লাখ ৩০ হাজার টনে উন্নীত হবে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীনে বর্তমানে ১৫টি চিনিকল আছে। এগুলোর বার্ষিক মোট উৎপাদন ক্ষমতা দুই লাখ ১০ হাজার টন। আগে এক লাখ টনের বেশি উৎপাদন করতে পারলেও এখন ৬০-৭০ হাজার টনের বেশি উৎপাদন করতে পারে না। প্রতিবছরই তাদের চিনি উৎপাদন কমছে, বিপরীতে বাড়ছে লোকসান। ট্যারিফ কমিশন বলছে, দেশে যে পরিমাণ আখ উৎপাদিত হয়, তার অর্ধেকও চিনিকলগুলো পেলে তাদের উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু আখ চাষিরা দাম কম হওয়ায় এবং বিক্রীত আখের দাম সময়মতো না পাওয়ায় গুড় উৎপাদকদের কাছে আখ বিক্রি করে দেন। ফলে লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না বলেই আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে।
সোর্স : কালের কণ্ঠ পৃষ্ঠা ৪ / ০১ নভেম্বর ২০২০
আপনার মতামত জানানঃ