হেরোইন আত্মসাতের জন্য রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। গোদাগাড়ীর পাশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার পোলাডাঙ্গা গ্রামের রফিকুল ইসলাম (৩২) হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামি ইসাহাক আলী ওরফে ইসা (২৯) আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এই অভিযোগ করেছেন।
গত শুক্রবার রাজশাহীর জ্যেষ্ঠ বিচার বিভাগীয় হাকিম উজ্জ্বল মাহমুদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ইসা। তিনি গোদাগাড়ী পৌর এলাকার মাদারপুর গ্রামের রেজাউল ইসলামের ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
নিহত রফিকুল ইসলাম পোলাডাঙ্গা গ্রামের ফজলুর রহমানের ছেলে। গত ২২ মার্চ গোদাগাড়ীর দেওয়ানপাড়া পদ্মার চর থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ উদ্ধারের পর থানা পুলিশ বজ পাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে একটি অপমৃত্যুর মামলা করে।
পুলিশের হাতে রফিকুল খুন হয়েছে দাবি করে আসামি ইসার জবানবন্দির ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেউ জবানবন্দিতে পুলিশের নাম বললেই যে পুলিশ জড়িত, সেটাও বলা যাবে না। আবার পুলিশ জড়িত নয়, সেটাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। জবানবন্দির নথিপত্র দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আসামি ইসাহাক আলী ইসার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রফিকুল হত্যাকাণ্ডে গোদাগাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান, আবদুল মান্নান, রেজাউল ইসলাম, কনস্টেবল শাহাদাত হোসেন ও শফিকুল ইসলামের নাম এসেছে।
এসআই মিজানুর রহমান ও কনস্টেবল শফিকুল এখনো সেখানে কর্মরত। মাস দুয়েক আগে এসআই মান্নান, রেজাউল ও কনস্টেবল শাহাদাতকে অন্যত্র বদলি করা হয়। তাঁদের মধ্যে রেজাউল পাবনার ঈশ্বরদী থানায় আছেন। অন্য দুজন কোথায় আছেন জানা যায়নি।
জানা গেছে, নিহত রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রুমিসা খাতুন (২৬) বাদী হয়ে গত ১৭ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আবদুল মালেকের ছেলে শরিফুল ইসলাম (৩২) ও একই এলাকার আজাদ আলীর ছেলে জামাল উদ্দিনকে (৩২) আসামি করে গোদাগাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
আদালত সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ২১ মার্চ রাতে গোদাগাড়ী থানার অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বা থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রেকর্ড না করেই দেওয়ানপাড়া পদ্মার চরে মাদক উদ্ধার অভিযানে যান। পুলিশের দলটি সেখান থেকে জামাল উদ্দিনকে ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক করে। থানায় ফিরে ওই রাতেই পুলিশ জামালকে গ্রেপ্তার ও রফিকুলকে পলাতক আসামি দেখিয়ে মাদক আইনে মামলা করে। ২২ মার্চ সকালে রফিকুল ইসলামের লাশ ওই চরে পাওয়া যায়। এরপর পুলিশ তাঁর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। তিনি বজ পাতে নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে একটি অপমৃত্যুর মামলা করে।
আদালত ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামালকে গ্রেপ্তারের মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান গোদাগাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নিত্যপদ দাস। তিনি আদালতের মাধ্যমে আসামিকে দুই দিনের রিমান্ডে নেন। পরে জামাল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে জামাল বলেছেন, রফিকুল ও তিনি টাকার বিনিময়ে হেরোইন পারাপার করেন। ২১ মার্চ রাতে তাঁরা দুজন হেরোইনসহ পদ্মার চর পার হওয়ার সময় বজ পাতে রফিকুল মারা যান। আর তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
জানা গেছে, রফিকুল হত্যা মামলাটি গত ২৩ জুন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) হস্তান্তরের আদেশ দেন আদালত। ৭ জুলাই মামলার নথিপত্র থানা থেকে বুঝে পায় রাজশাহী পিবিআই। মামলাটি তদন্ত করছেন এসআই জামাল উদ্দিন। গত ২৮ অক্টোবর গোদাগাড়ীর মাদারপুর গ্রামের ইসাহাক আলী ইসা, ফরিদুল ইসলাম ও মাহাবুব আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে রফিকুল হত্যাকাণ্ড বিষয়ে সব কিছু খুলে বলেন ইসা। গত শুক্রবার তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ইসা তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন যে ঘটনার কিছুদিন আগে ১০০ গ্রাম হেরোইন পাঠানোর জন্য তিনি ভারতের মুর্শিদাবাদের কাশেম নামের এক ব্যক্তিকে দুই লাখ টাকা দেন। কাশেম প্রথমে তাঁকে নকল হেরোইন পাঠান। এরপর কাশেমের কাছে টাকা ফেরত চাইলে তাঁকে আসল হেরোইন পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ইসা বলেন, তিনি আরো ৪০০ গ্রাম হেরোইন বাকিতে দেওয়ার অনুরোধ করলে কাশেম রাজি হন। পাঠানোর দিনক্ষণ ঠিক হওয়ায় তিনি কাশেমকে ঠকানোর জন্য গোদাগাড়ী থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইসা দাবি করেছেন যে পুলিশের সঙ্গে তাঁর চুক্তি হয়, ওই হেরোইন ধরিয়ে দিলে তাঁকে দুই লাখ টাকা দিতে হবে। নকল হেরোইনসহ দুই বাহককে গ্রেপ্তার করবে। হেরোইনের সবটাই পুলিশ নিয়ে যাবে।
ইসার জবানবন্দি অনুযায়ী, পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১ মার্চ রাতে অভিযানে যায় গোদাগাড়ী থানার ওই পাঁচ পুলিশ সদস্য। তাঁরা রফিকুল ও জামালকে ধরে ফেলেন। রফিকুলের কাছে থাকা হেরোইন কেড়ে নিতে তাঁরা তাঁকে বেদম মারধর করেন। কিছুক্ষণ পর রফিকুল বালুর ওপর ঢলে পড়েন। রফিকুল মারা গেছেন—এটা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান বলে ইসা আদালতকে জানান। পরে তিনি জানতে পারেন রফিকুল বজ পাতে মারা গেছেন বলে মামলার নথিতে লেখা হয়েছে।
রাজশাহী পিবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে গুরুতর আঘাতজনিত কারণে রফিকুলের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঘটনার বিষয়ে গোদাগাড়ী থানার ওসি খাইরুল ইসলাম বলেন, তিনি গোদাগাড়ীতে যোগ দেওয়ার কয়েক দিন পরই পদ্মার চরে রফিকুলের লাশটি পাওয়া যায়। এর কয়েক দিন পরই মামলাটি পিবিআইতে চলে যায়। ওই হত্যাকাণ্ডে কোনো পুলিশ জড়িত কি না সে ব্যাপারে তিনি এখনো কিছু জানেন না।
সোর্স : কালের কন্ঠ, পৃষ্ঠা ১ / ০১ নভেম্বর ২০২০
আপনার মতামত জানানঃ