কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরায় বাংলাদেশকে নিয়ে করা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি ফেসবুক ও ইউটিউবসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরানোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আজ সোমবার (১৫ মার্চ) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের বিচারকদের স্বাক্ষরের পর আল-জাজিরার প্রতিবেদন নিয়ে ৩৭ পৃষ্ঠার এই রায় প্রকাশ করেন আদালত।
রায়ে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ যেন প্রতিবেদনটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনলাইন থেকে সরিয়ে ফেলে এবং পুনরায় আপলোড না করে সে বিষয়ে অনুরোধ জানাতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) তাৎক্ষণিকভাবে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলেছেন আদালত।
এর আগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আল জাজিরা টেলিভিশন নেটওয়ার্কে প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ সব অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
আদালতে ওইদিন রিটের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। বিটিআরসির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রেজা-ই রাকিব।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে আল–জাজিরার প্রচারিত তথ্যচিত্র ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল উল আলম হাইকোর্টকে বলেছিলেন, ঘণ্টাব্যাপী একটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করা হলো। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম বলা হচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেদনটিতে তার (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে কোনো যোগসূত্র দেখাতে পারেনি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিকে বিতর্কিত করা হলে রাষ্ট্রকেই বিতর্কিত করা হয়।
এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আল-জাজিরায় সম্প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামের প্রতিবেদন ও তথ্যচিত্র সরাতে রাজি হয়েছে মর্মে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানালেও পরে তা বিতর্কের জন্ম দেয়। কেননা মন্ত্রীর কথা অস্বীকার করে ফেসবুক জানায়, ‘আমরা বিটিআরসির (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন) কাছ থেকে ডকুমেন্টারি সরিয়ে নেওয়ার জন্য হাইকোর্টের লিখিত নির্দেশনা পাইনি। আমরা এই বিষয়ে কোনও বিবৃতি দিইনি।’
তার আগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রিটের ওপর অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ছয়জন সিনিয়র আইনজীবী তাদের মত তুলে ধরেন। এর ধারাবাহিকতায় ওই দিন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের শুনানি উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করেন আদালত।
অ্যামিকাস কিউরি হলেন আদালতের আইনি সহায়তাকারী। রিট আবেদনকারীর সংক্ষুব্ধ হওয়ার দিক, রিটের প্রার্থনা অনুসারে এই আদালত থেকে কোনো আদেশ দেয়া হলে বিদেশি কোনো টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা যাবে কি না, কোনো আইনি নোটিশ ছাড়া রিট (ম্যান্ডামাস) চলে কি না, রিটের প্রার্থনা অনুসারে এই আদালত থেকে আল-জাজিরার তথ্যচিত্রটি সব অনলাইন মাধ্যম থেকে বন্ধ করার কোনো নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন আছে কি না, ১ ফেব্রুয়ারি তথ্যচিত্রটি প্রকাশের পর এত দেরিতে রিট করার প্রেক্ষাপটে কোনো নির্দেশ দেয়ার প্রয়োজন আছে কি না—এসব বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত দিতে বলা হয়। এরপর ওই নিয়োগ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের ৬ আইনজীবী তাদের মতামত আদালতের সামনে তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে আল-জাজিরার সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে করা রিটটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দেন পাঁচ অ্যামিকাস কিউরি। এই পাঁচ অ্যামিকাস কিউরি হলেন এ জে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম কামাল, কামাল উল আলম, প্রবীর নিয়োগী ও শাহদীন মালিক।
একজন অ্যামিকাস কিউরি দেশে আল জাজিরা বন্ধের পক্ষের মত দেন। তিনি হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ও সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল মতিন খসরু। অ্যামিকাস কিউরি আবদুল মতিন খসরু বলেন, রিট আবেদনকারী ব্যক্তিগত ও জাতীয়ভাবে সংক্ষুব্ধ। আদালত ওই তথ্যচিত্র অপসারণের নির্দেশনা দিতে পারেন।
বাংলাদেশ থেকে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। একই সঙ্গে রিটে সংবাদমাধ্যমটির প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ প্রতিবেদনটি ইউটিউব, টুইটার, ফেসবুকসহ সব অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে অপসারণ করার নির্দেশনা চাওয়া হয়। ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমন এ রিট দায়ের করেন। রিট আবেদনে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সচিব, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব, বিটিআরসি‘র চেয়ারম্যান, পুলিশের আইজিসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
এর আগে আল-জাজিরার এডিটর জেনারেল মোস্তফা সরওয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার একটি আবেদন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সুনাম হানি করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অপপ্রচারের অভিযোগে ঢাকার মহানগর হাকিম মো. আাশেক ইমামের আদালতে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট মশিউর মালেক এ আবেদন করেন।
মামলার আসামিরা হলেন- আল জাজিরা টেলিভিশনের ডিরেক্টর জেনারেল মোস্তেফা স্যোউয়াগ, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ডেভিড বার্গম্যান, শায়ের জুলকার নাইন ওরফে সামি এবং নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল।
তবে প্রতিবেদনের সাথে সংশ্লিষ্ট চার জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আবেদন শুনানি শেষে তা ফেরতও দিয়েছেন আদালত।
এ বিষয়ে মামলার আবেদনকারী বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি মশিউর মালেক জানান, আদালত বলেছে যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়েরের জন্য সরকারের অনুমোদন থাকার দরকার হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন না থাকার কারণে আবেদনটি বাতিল করার কথা জানানো হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৮
আপনার মতামত জানানঃ