নারায়ণগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক দুটি মামলা করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার ১৫ দিন পর গতকাল বুধবার(১০ মার্চ) নিজ পদ থেকে অবশেষে সরে দাঁড়িয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন। এর পরপরই ভারপ্রাপ্ত পিপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান বুলবুল।
বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন ও তার স্ত্রী সেলিনা ওয়াজেদ মিনুর বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম। মামলায় সরকারি এই আইনজীবী দম্পতির নামে দুই কোটিরও বেশি অবৈধ সম্পদের কথা মামলায় উল্লেখ করেছে দুদক। ওয়াজেদ আলী খোকন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদেও রয়েছে। দুদকের মামলার পরও গত কয়েকদিন তিনি পিপি হিসেবে আদালতের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর জেলা আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
তবে বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের ডেকে পিপির পদ থেকে সরে গিয়ে মনিরুজ্জামান বুলবুলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন ওয়াজেদ আলী খোকন।
ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, ২০১৫ থেকে আমি এই পদে দায়িত্ব পালন করেছি। এর মধ্যে চাঞ্চল্যকর ৭ খুন, ৫ খুন, স্মর্ণব্যবসায়ী, শিশু হত্যা, নারীহত্যা সহ অসংখ্য মামলায় সাফল্য অর্জন করেছি। কিন্তু হঠাৎ করেই গত মাসে (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুদক থেকে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়, ১৯৯০ থেকে এ পর্যন্ত আমার স্ত্রীর নামে ২৭ লাখ টাকার অধিক সম্পদের তথ্য গোপন করেছি। আর আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি ৮৫ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছি।
৩১ বছর বিশাল ব্যবধান। জাপানে ছিলাম, ওকালতি পেশা, ৫ বছরের পিপির পেশা। এতদিনে একজন শ্রমিক বা রিক্সাওয়ালারও এর চেয়ে বেশি সম্পদ থাকে। জিনিসটা আমার কাছে খুব বিব্রতকর মনে হলো, আমি জেলা বিচার ব্যবস্থার একজন প্রধান।
আমার যারা অভিভাবক আত্মীয়স্বজন, তারা আমাকে উপদেশ দিলো তদন্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তুমি অবসর নাও। যোগ্য একজনকে দায়িত্ব দাও। আমার ৭ জন এডিশনাল পিপির মধ্যে সব কিছু চিন্তা করে মনিরুজ্জামান বুলবুল সাহেবকে যোগ্য মনে করি। তাই আমি তাকে ভারপ্রাপ্ত পিপি হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছি।
আমি নিজে যেহেতু বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট, তাই আমি নিজেও বিব্রতবোধ করি। কারণ আমি একটা ভালো চেয়ারে বসে থাকলে তদন্ত কর্মকর্তা বার বার আমাকে স্যারই বলবে। এতে তদন্তে ব্যাঘাত ঘটবে। তাই আমি তদন্তের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের দেশে সচরাচর এটা কেউ পালন করে না, আমি একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি।
ভারপ্তাপ্ত পিপি বুলবুল বলেন, উনি স্বপদে বহাল থাকলে মামলার তদন্ত ব্যহত হতে পারে উনি এটা ভেবে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নিয়েছেন। আমি আশা করি ওয়াজেদ আলী খোকনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে তিনি মুক্তি পাবেন।
স্বপদে ফেরা নিয়ে সাবেক পিপি ওয়াজেদ আলী বলেন, স্বপদে ফেরা বা স্থায়ী পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া মন্ত্রণালয়ের বিষয়। নতুন যিনি আসবেন বা বুলবুল ভাইও যদি আসেন আমার সমস্যা নাই। কারণ আমরা একই ব্যক্তি।
যেসব গুরুত্বপূর্ণ মামলা এখনো কার্যরত আছে সেগুলো সম্পর্কে পিপি ওয়াজেদ বলেন, ২৩টি গুরুত্বপুর্ণ মামলা আছে সেগুলো ১৫ দিনের মধ্যে নতুন পিপির কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সাবেক পিপির পদত্যাগ ও ভারপ্রাপ্ত পিপির দায়িত্ব গ্রহণের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিচার বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ ও গণমাধ্যমকর্মীরা।
মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এস এম ওয়াজেদ আলী খোকনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পুরনো। তবে বিষয়টি এর আগে কখনও মামলা বা তদন্ত পর্যায়ে যায়নি। তবে এবার তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় খোকন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুটি মামলা দায়ের করে দুদক এর সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১। এ ঘটনার পর ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এর পরপরই তার পিপি পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অবশেষে মামলা দায়েরের দুই সপ্তাহ পরে এ দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
আইনজীবী ওয়াজেদ আলী খোকন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ওয়াজেদ আলী খোকন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আলাদা দু’টি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতি দমন সম্মিলত কমিশন ঢাকা-২ এ মামলা দু’টি করা হয়। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম মামলা দু’টি করেছেন।
প্রথম মামলার অভিযোগে বলা হয়, এসএম ওয়াজেদ আলী খোকন কমিশনে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তার নিজ নামে ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের নামে অর্জিত ৮৫ লাখ ৩২ হাজার ৩৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য প্রদর্শন না করে গোপনপূর্বক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দেন। গোপন করা সম্পদসহ মোট ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫৫ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এ মামলাটি দায়ের করা হয়।
অপর মামলায় বলা হয়েছে, মিসেস সেলিনা ওয়াজেদ মিনু দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তার নিজ নামে ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ১৬১ টাকার সম্পদের তথ্য প্রদর্শন না করে গোপনপূর্বক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়েছেন। গোপন করা এই সম্পদসহ মোট ১ কোটি ১ লাখ ৫৬ হাজার ১৭৪ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াজেদ আলী খোকন একদিকে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অপরদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের উচ্চপদধারী একজন ব্যক্তি। বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অর্জনের জন্য তিনি যথেষ্টই ক্ষমতা ও প্রভাব পেয়েছেন। একজন আইনজীবীর পক্ষ থেকে এরকমটি যেমন প্রত্যাশিত নয় তেমনি একজন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হিসাবেও তেমন অপ্রত্যাশিত নয়। ওয়াজেদ আলী খোকনের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক, দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারের সম্মুখীন করা হোক। তবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে আইন কতটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে, এনিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৪
আপনার মতামত জানানঃ