মামুন আব্দুল্লাহ : আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা। ২০২১ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য: “’করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব।” প্রতি বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয় কারণ নারীরা এখনও পর্যন্ত পূর্ণ অধিকার পায়নি, সে যতই খাতা-কলমে উন্নয়ন, নারী নেতৃত্ব, কর্মক্ষেত্রে সমান অধিকার, নারীর ক্ষমতায়নের বুলি কপচান। প্রান্তিক পর্যায়ে বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। বহু উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এবং স্বল্প উন্নত রাষ্ট্রে নারীদের অবস্থা সার্বিকভাবে খুবই খারাপ। রিপোর্ট অনুযায়ী বহু দেশে নারীরা এখনও ঘর বন্দী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর অধিকার, সম্মান, ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব কলঙ্কিত রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় খুব যে ভালো এটা উল্লেখই করা যাবে না। ডেভেলপিং ও আন্ডার ডেভেলপিং রাষ্ট্র সমূহে নারীর যে অধিকার বাংলাদেশেও তাই। খুব একটা তফাৎ এখানে পাওয়া যায় না।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
পুরুষ প্রধান পৃথিবীতে যত নিয়ম-নীতি এর সবই পুরুষের তৈরি। প্রশাসনিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে এমনভাবে গঠিতই হয়েছে যেখানে পুরুষরাই সহজে সুবিধা করে উঠতে পারে। নারী যেন এই ক্ষমতা থেকে বাহিরে থাকে, তাকে যেন এই ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এজন্য গঠিত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্মীয় নিয়মকানুন, আইন সামাজিক ব্যবস্থা ইত্যাদি। একটা সময় নারীদের প্রশাসনিক ক্ষমতা পরিচালনার করার অযোগ্য মনে করা হত। তাদের স্বল্প বুদ্ধির প্রাণী ভাবা হত বিভিন্ন গবাদিপশুর সাথে তুলনা করে।
জাতিসংঘ ১৯৭৭ সাল থেকে নারী দিবস পালন করে আসছে। কিন্তু প্রথমবার পালন করা হয়েছিল ১৯০৯ সালে আমেরিকায়। তখন সোশ্যালিস্ট পার্টি ২৮ ফেব্রুয়ারি এই দিবসটি পালন করেছিল। ১৯১০ সাল থেকে তখন বিভিন্ন অর্গানাইজেশনের আয়োজনে ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ওম্যান্স কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হতো বিশেষ নারী দিবস হিসেবে। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখন সেই দেশে সর্বপ্রথম ৮ মার্চকে নারী দিবস ঘোষিত করে সরকারী ছুটির ব্যবস্থা করে। নারী দিবস পালনের ক্ষেত্রে কমিউনিজমের বড় অবদান রয়েছে। কারণ কমিউনিজমই প্রথম সকল মানুষ যে সমান এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে।
বাংলাদেশে নারী অধিকার
বাংলাদেশের নারীরা ভোটের অধিকার পায় স্বাধীনের পরে, অর্থাৎ ১৯৭২ সালে। ভোটের অধিকার এর অর্থ হ’ল সেই অঞ্চলে মানুষের মাঝে সম-অধিকার রয়েছে। ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই দেশের গণতন্ত্র শেষ হয়ে যায়। নারী-পুরুষের অধিকার বিবেচিত হয় সেই দেশে কার কার ভোট প্রদানের অধিকার রয়েছে এর উপরে। পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ রাষ্ট্র হিসেবে ভোটের অধিকার প্রদান করেছে সৌদি আরব। ভোটের অধিকার পাওয়ার এত সময় পরেও বাংলাদেশে নারীদের অধিকারের অবস্থা বেশ খারাপ।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বের বহু পরিকল্পনা করা হয়। বাংলাদেশের নারীদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হলে উপমহাদেশেরও নারীদের সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে। সে সময় শুধু ভারতে না, সমগ্র পৃথিবীতেই নারীদের অবস্থা সঙ্গিন ছিল। হাজার খানেক বছর পূর্বে রোমান সাম্রাজ্যে শিক্ষিত নারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তাদের ডাইনী ঘোষিত করা হত। আরবে নারীরা ছিল শুধু উপভোগের পণ্য। নারীকেও যে ভোগ্যপণ্যের মতো ক্রয় বিক্রয় করা যায় এই ধারনার সাথে মানবজাতিকে সর্বপ্রথম পরিচিত করায় আরবরা। উপমহাদেশে অনেক কিছুই হ’ত যা আধুনিক সময়ের অনুপাতে বর্বর হিসাবে বিবেচিত হবে। নারী ও শিশু-ভ্রূণ হত্যা, যৌতুক প্রথা, শিশু বিবাহ, নিষিদ্ধ বিধবা বিবাহ মুসলিম ও হিন্দু উভয় সমাজেই দেখা যেত এবং এখনও দেখা যায়। এখন পর্যন্ত ২৬/২৭ বছর বয়সী অবিবাহিত নারীদের সমাজে নিচু চোখে দেখা হয়। বিবাহের বয়স যদিও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের আইনে ১৬ বছরের নিচে নারীদের বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা এক প্রকার বর্বরই বলা যায়। বিবাহের নুন্যতম বয়স হওয়া উচিত ১৮। কয়েক দশক পূর্বেও ১৬ বছর মেয়েদের বিবাহ উত্তীর্ণ বয়স বলেই বিবেচনা করা হত। ৮/১০ বছর বয়সেই মেয়ে শিশুদের বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হত। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনও বহু কিশোরী বধূ দেখতে পাওয়া যায়। পিউবার্টি শুরু হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে এমন মেয়ে শিশুর সংখ্যাও কম না। এমন শিশুদের বিয়ে হতো ৫০-৪০ বছরের পৌঢ় বৃদ্ধদের সাথে। সেই শিশুরা যখন ২৫-৩০ বছরের যুবতী হতো তখন বেশিরভাগ সময় তাদের স্বামী পরকালে যাত্রা শুরু করত। বিধবা যদি হিন্দু সমাজের হয় তাহলে তাদের বিয়ে তো ধর্মীয় ভাবেই নিষিদ্ধ। হিন্দু বিধবাদের সাদা শাড়ি প্রদান করা হত, তাদের চুল কেটে ফেলা হত, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হত, অচ্ছুৎ বানিয়ে ফেলা হত। বহু নারী বেঁচে থাকার তাগিদে পতিতাবৃত্তিতে ঝুঁকে পড়তো। তারা ভালো কিছু খেতে পারত না, পর পুরুষের দর্শন করতে পারত না, চোখ নামিয়ে চলতে হত ইত্যাদি। হিন্দু ধর্মে ছিল সতী প্রথার মতন একটি মহাকুপ্রথা। স্বামীর মৃত্যুর পর সতীত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে স্বামীর চিতায় স্ত্রীর জীবন্ত চিতা সাজানো হতো। মুসলমানদের অবস্থা যে এমন না এটাও বলা যাবে না, গ্রামীণ সমাজই এর প্রমাণ। মুসলিম নারীদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থাতেও একটু কৌতুক করে বললে, মুসলিম নারীরা দুই রঙের কাপড় দিয়েই জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। বিয়ের দিন লাল এবং বাদবাকি জীবন কালো। ইসলামে নারীদের ঘর থেকে বের হওয়ার উপরেই রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। যে নারীদের বাইরে দেখা যায় তারা স্রেফ বেশ্যা ছাড়া আর কিছুই না। সাক্ষী হিসেবে দুইজন নারী সমান একজন পুরুষ। দুইজন নারীর ভোট সমান একটি ভোট যে গণনা করা হয় না, এটা তো মুসলিম নারীদের সৌভাগ্য।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ ধারা অনুযায়ী, সব নাগরিক সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকেরই সমান সুযোগ ও অধিকার থাকবে। সেখানে রাষ্ট্র নারী পুরুষের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য রাখবে না। লিঙ্গের কোন বৈষম্য থাকবে না। অর্থাৎ যেখানে যেখানে নারী ও পুরুষ এক সঙ্গে কাজ করবে সেখানে নারী ও পুরুষ সমান বেতন পাবে। নারীর অধিকার রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক বৈষম্য বিলোপ সনদ রয়েছে। বাংলাদেশ সেই সনদে সাক্ষরও করেছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন খাতা কলমে প্রায় শূন্যের কোঠায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এসিড সন্ত্রাস দমন আইন ২০০২ ও যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১ঌ৮০, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন সমূহ প্রমাণ করে এই কুপ্রথাগুলো আমাদের সমাজকে কীভাবে গ্রাস করে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম নারী নীতি গৃহীত হয় ১৯৯৭ সালে। এরপর সেই নীতি সংশোধন করা হয়েছে ২০০৪, ২০০৮ ও ২০১০ সালে। কিন্তু এসবের প্রয়োগে এবং সমাজে নারীর উপর অপরাধ ও নির্যাতনের পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে বাস্তব চিত্রটা ফুটে ওঠে। অর্থাৎ সংবিধানের সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন ঘটছে এখানেই। নারীর সম্মান কখনোই একজন পুরুষের সমান হয় না। এমন বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে আপনার আমার ঘর থেকেই।
এরপরও আমরা বাংলাদেশে কিছু রোল মডেল দেখাতে পারব। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, বেগম রোকেয়া, তসলিমা নাসরিন, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, আইরিন খান, প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, আমাইরা আহমেদ, ড. ফারজানা ইসলাম প্রমুখ। জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৪৯ বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮ তম। দেশের ৯৬ শতাংশ মেয়ে শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে। শ্রমখাতে নারীর অবদান ৩৬%। ২ কোটি নারী সরাসরি শ্রমবাজারে জড়িত। দেশের মোট উদ্যোক্তার ৩৯ শতাংশ নারী। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে শুধুমাত্র নারীর পরিশ্রমে লেনদেন হয়েছে ১১.৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারী চাকুরীজীবীর ২৭ শতাংশ নারী। ১২৭৬ জন নারী বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে কাজ করছেন। সংসদে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত।
নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী নেতৃত্বে একটি সম্মানজনক অবস্থানে থাকার পরও গ্রাউন্ড সিচুয়েশন ভিন্ন। এসিড নিক্ষেপের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, কিন্তু নারীর উপরে এসিড নিক্ষেপের মতন ঘটনা নিয়মিত ঘটে। শুধু নিক্ষেপ নয়, জোর পূর্বক এসিড খাইয়ে দেওয়ার ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে ৭০% নারী ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার।ASK এর তথ্য মতে প্রতি বছর ২৩০ জন নারী স্বামীর দ্বারা খুন হোন। ২০০১ এর জানুয়ারি থেকে ২০১৯ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩,৩০০ জন নারী যৌতুকের জন্য প্রাণ হারিয়েছেন। যৌতুকের কারণে নির্যাতন শুধু স্বামীর পক্ষ থেকে না বরং স্বামীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের হাতেও নির্যাতিত হয়। এটা শুধু গ্রামীণ প্রেক্ষাপটই না, শহরে এমনকি হাই প্রোফাইল পরিবারগুলোতেও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। রিপোর্ট হয় শুধু মাত্র সেই সমস্ত ঘটনাগুলো যা সহিংসতার সকল স্কেল পূর্ণ করে। কোভিড-১৯ কালীন সময়ে নারীর উপরে সহিংসতার মাত্রা ৭০% বৃদ্ধি পেয়েছে। BBS এর রিপোর্ট বলছে, যে সমস্ত বিবাহিত নারীরা নির্যাতনের শিকার হয় তাদের মাঝে যারা বেঁচে যান, এর ৭০% নিশ্চুপ থাকেন। জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্সও বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বেশি। পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন, বাংলাদেশের নারীদের ভাগ্য বদলাতে পারে শুধু সামাজিক ধ্যান ধারণা, কুশিক্ষা, গোড়ামি থেকে মুক্তি পাওয়ার মধ্য দিয়ে।
আপনার মতামত জানানঃ