২০১৫ সালের ২৬ মার্চ সৌদি আরব জোটবদ্ধভাবে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর অন্যতম ইয়েমেনের ওপর সামরিক হামলা চালায়। ওই সময় তাদের ধারণা ছিল যে, তারা দুয়েকদিনের মধ্যেই ইয়েমেনের দখল নিতে পারবে। যদিও এমন ধারণা সৌদি আরবের জন্য শুধু ভুলই প্রমাণিত হয়নি, উপরন্তু তাদের জন্য এখন এক ধরনের বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সৌদি আরব যে হুথিদেরকে নির্মূল করে আব্দু রাব্বু মানসুর হাদিকে ক্ষমতায় পুনর্বহাল করতে চেয়েছিল, সেই লক্ষ্য তারা পূরণ করতে পারেনি। বরং তারা ইয়েমেন যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আটকে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি যা তাতে স্পষ্টভাবে বলা যায়, এই যুদ্ধ তাদের জন্য ভয়াবহ পরাজয় ডেকে আনতে যাচ্ছে।
সংঘর্ষে ২৪ ঘন্টায় নিহত ৯০ যোদ্ধা
শনিবার ২৪ ঘণ্টায় ইয়েমেনের সরকারি বাহিনী ও হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৯০ যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। এছাড়াও এতে কয়েক ডজন লোক আহত হয়েছেন।- বার্তা সংস্থা এএফপি।
উত্তর ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট-সমর্থিত সরকারপন্থী বাহিনীর সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি মারিব ছিনিয়ে নিতে গত মাসে শিয়া বিদ্রোহীরা আক্রমণ চালিয়েছিল। এটি দেশটিতে সৌদি-নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট সমর্থিত সরকারি বাহিনীর হাতে থাকা সর্বশেষ ঘাঁটি।
সূত্র মতে, তেল-সমৃদ্ধ প্রদেশটিতে সংঘর্ষে সরকারি বাহিনীর ৩২ যোদ্ধা নিহত হন। আর সৌদি জোটের বিমান হামলায় ৫৮ হুতি বিদ্রোহীর প্রাণহানি ঘটে।
জানা যায়, মারিব শহরের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় কাসারা রণক্ষেত্রে হুতিরা অগ্রসর হতে পারলও সরকারি বাহিনী পাল্টা হামলা চালাতে সক্ষম হয়। অন্তত ছয়টি ফ্রন্টে দুপক্ষের মধ্যে ব্যাপক লড়াই হয়েছে। সেখানে হুতি বিদ্রোহীদের তীব্র জবাব দিচ্ছে ইয়েমেনের সরকারি বাহিনী। ইরান সমর্থিত হুথিরা মারিব শহরের শুধুমাত্র উত্তরপশ্চিম কাসারা ফ্রন্টে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছে। এ লড়াইয়ে কয়েক ডজন যোদ্ধা আহত হয়েছেন।
মারিব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারানো ইয়েমেনি সরকারের জন্য বড় ধাক্কা। তবে এতে বেসামরিক মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ লড়াইয়ে হাজার হাজার অধিবাসী ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। তারা মরুভূমির বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন।
এ ছাড়া এটি সৌদি আরবের জন্যও বড় ধাক্কা হতে পারে। হুতিদের এই অগ্রগতি প্রতিবেশী সৌদি আরবের জন্যও বিপত্তির কারণ হয়ে দেখা দেবে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশটিতে প্রায়ই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে দেখা গেছে ইয়েমেনি বিদ্রোহীদের। শুক্রবারও সৌদি বিমান বাহিনী কয়েকটি ড্রোন হামলা প্রতিহতের কথা জানায়। সৌদি রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিমে ওই ড্রোন হামলায় ১০ বছরের এক শিশুসহ দুই বেসামরিক নাগরিক আহত হয়।
এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকিন মারিবে অভিযান বন্ধে হুতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও দাতাদের সম্মেলনে ১৯ কোটি ১০ লাখ ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কেবল সহায়তা দিয়ে সংঘাত বন্ধ করা যাবে না। এই যুদ্ধ বন্ধের মাধ্যমে আমরা ইয়েমেনে মানবিক সংকটের অবসান ঘটাতে পারবো। কাজেই যুদ্ধ বন্ধে জোরালোভাবে কূটনৈতিক চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুদ্ধে ইয়েমেনের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি
২০১৫ সালের ২৬ মার্চ সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত বর্তমান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তখন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন এবং তখনও তিনি যুবরাজের পদে অধিষ্ঠিত হননি।
যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া ছাড়াও সৌদি আরব ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে খাদ্য ও ওষুধসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ক্ষুধা ও বিভিন্ন ধরনের রোগে মৃত্যুর এটা বড় কারণ।
অধিকার ও উন্নয়ন বিষয়ক একটি গবেষণা কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে ইয়েমেন যুদ্ধে সরাসরি প্রায় ১৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। যার মধ্যে ৯ হাজার ৬৮২ জন পুরুষ, ২ হাজার ৪৬২ জন নারী ও ৩ হাজার ৯৩১ জন শিশু রয়েছে। এ ছাড়া অসম এ যুদ্ধে সরাসরি আহত হয়েছে ২৫ হাজার ৪০০ ব্যক্তি যার মধ্যে ৪ হাজার ২০০টি শিশু, তিন হাজারের বেশি নারী এবং ১৮ হাজার ১০০ এরও বেশি পুরুষ রয়েছে। সরাসরি হতাহতের বাইরেও আরো অনেক ব্যক্তি এ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।
বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মোট নিহতের সংখ্যা এক লাখের বেশি। কেননা সৌদি আরবের সরাসরি হামলা ছাড়াও ক্ষুধা ও বিভিন্ন ধরনের রোগে এসব মানুষ মারা গেছে। এ ছাড়া শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
ইয়েমেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তোহা আল মোতাওয়াক্কেল এক ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরে বলেছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও অবরোধের কারণে চিকিৎসার অভাবে বছরে ৫০ হাজার শিশু প্রাণ হারাচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সমন্বয়কারী দফতর এক প্রতিবেদনে বলেছে, যুদ্ধ পীড়িত ইয়েমেনের দুই কোটি ২ লাখ মানুষের জন্য ত্রাণের প্রয়োজন। এর মধ্যে এক কোটি চার লাখ মানুষের জন্য জরুরিভিত্তিতে সাহায্যের দরকার। যুদ্ধের কারণে ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী জীবন যাপন করছে।
অধিকার ও উন্নয়ন বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধের কারণে ইয়েমেনের ১৫টি বিমান বন্দর, ১৪টি সমুদ্র বন্দর, দুই হাজার ৭০০টি মহাসড়ক ও সেতু, ৪৪২টি যোগাযোগ কেন্দ্র, ১৮শ’ ৩২টি সরকারি প্রতিষ্ঠান, চার লাখ ২৮ হাজার ৮০০টি আবাসিক ভবন, ৯৫৩টি মসজিদ, ৩৪৪টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হাসপাতাল, ৯১৪টি স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১৭৮টি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র, ৩৫৫টি কারখানা, ৭৭৪টি খাদ্য বিক্রয় কেন্দ্র এবং ৩৭০টি তেল পাম্প স্টেশন হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অথবা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
পশ্চিম এশিয় অঞ্চলে রেডক্রিসেন্টের মুখপাত্র সারা আল জুগ্বারি কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘যুদ্ধ অব্যাহত থাকায় ইয়েমেনের বিভিন্ন শহরে জনগণের কাছে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির মাত্র ৫১ শতাংশ হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র চালু রয়েছে। এ ছাড়া, খাদ্য, চিকিৎসা ও ওষুধের অভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগের বিস্তার ঘটছে। ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে এরই মধ্যে অনেক হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হয়েছে।’
ইয়েমেনে যুদ্ধের অবসান চান বাইডেন
প্রেসিডেন্ট হিসাবে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বাইডেনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে বাইডেন বলেন, ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের মিত্রদের কাছে অস্ত্র বিক্রিসহ সকল সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন তিনি
তিনি ইয়েমেনে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে সৌদি আরবের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার এবং নাটকীয়ভাবে শরণার্থীদের প্রতি সমর্থন জোরদার করেছেন। বাইডেন ইয়েমেনে বিশেষ দূত হিসেবে টিমুথি লেনডারকিংকে নিয়োগ দিয়েছেন।
ইয়েমেনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “এই যুদ্ধের অবসান করতে হবে।”
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এই দূত জাতিসংঘের যুদ্ধ বিরতি প্রচেষ্টা এবং সরকার ও হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে শান্তি আলোচনায় সহায়তা করবে। হুতিরা রাজধানী সানাসহ দেশটির বেশীরভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।
যুদ্ধের অবর্ণনীয় দুর্দশায় থাকা ইয়েমেনের জনগণের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে।
ইয়েমেনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “এই যুদ্ধের অবসান করতে হবে।”
যুদ্ধে সৌদিকে সহায়তা বন্ধ
২০১৫ সালের মার্চ মাসে যখন সৌদি জোট ইয়েমেনে হামলা চালায় তখন থেকেই তথ্য দিয়ে, অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে, লজিস্টিক সহায়তা দিয়ে সৌদি জোটকে সহযোগিতা করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে সম্প্রতি হোয়াইট হাউসের জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনে সমর্থন দেয়া বন্ধ করবেন। এই অবস্থানের কথা জো বাইডেন নিজেও জানিয়েছেন।
ইয়েমেন যুদ্ধকে ‘কৌশলগত বিপর্যয়’ হিসেবে অভিহিত করে বাইডেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে। ইয়েমেনে আগ্রাসনে অস্ত্র বিক্রিসহ সকল সহযোগিতার অবসান ঘটাতে হবে।
তবে তিনি এটাও বলেছেন, সৌদি আরব ইরান-সমর্থিত বাহিনীর হামলার হুমকির মুখে রয়েছে। সৌদি আরবকে তার আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সহায়তা করবে আমেরিকা।
উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই বাইডেন প্রশাসন এক মাসের জন্য আনসারুল্লাহ’র ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। পাশাপাশি সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রয়ও স্থগিত করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান যেখানে সমর্থন দিয়েছে সেখানে থেকে খুব সহজেই নিজেদের প্রত্যাহার করেনি। বোঝা যায়, ইরানের সমর্থন মোটেই নড়বড়ে নয়। পাশাপাশি ইরানি প্রযুক্তির কাছে আমেরিকার সামরিক প্রযুক্তি নগণ্য বলেই ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ইরান যদি হুথিদের সমর্থন দেয় তবে সেটা সামরিক সমর্থন হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে হুথিদের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির পেছনে ইরানের মেধা থাকার কথা। সেই ড্রোন যখন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে খুবই কার্যকর বলে প্রমাণ হচ্ছে তখন ধরে নিতে হবে ইরানি মেধা ও প্রযুক্তি কাজ করছে। সেক্ষেত্রে ইরান ও ইয়েমেনের হুথিদের সামনে এখন লক্ষ্য একটাই। তারা এই যুদ্ধ থেকে আর পেছনে ফিরে আসবে না। জয়-পরাজয় ছাড়া হুথিদের এই যুদ্ধের অবসান ঘটবে বলে মনে হচ্ছে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ