বিশেষ প্রতিনিধি : এই সপ্তাহে ভারতের এক মুসলিম সাংবাদিক কারাগারে তার পাঁচ মাস পূর্ণ করেছেন। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত পরিবারের এক কিশোরীকে গণধর্ষণের পর হত্যার খবর সংগ্রহ করতে যাওয়ার পথে মথুয়ার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিকি কাপ্পান। ৪১ বছর বয়সী সিদ্দিকি কাপ্পানকে গত বছর অক্টোবরে গ্রেফতার করা হয়।
হাথরস উত্তর প্রদেশের ছোট একটি শহর, রাজধানী নয়া দিল্লি থেকে প্রায় ২০০ কি.মি. দূরে অবস্থিত। সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ, ১৯ বছর বয়সী দলিত কিশোরীকে হিন্দুদের মধ্যে প্রভাবশালী ঠাকুর সম্প্রদায়ের চার ব্যক্তি গণধর্ষণ করে। অত্যাচারে মেয়েটির স্পাইনাল কর্ড মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর নয়া দিল্লির একটি হাসপাতালে দুই সপ্তাহ পর তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় ভারতজুড়ে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল।
ঘটনাকে আরও জটিল করে ৩০ শে সেপ্টেম্বর রাত ২ টা ৩০ মিনিটে হাথরসের কর্তৃপক্ষ পরিবারের অনুমতি না নিয়েই মেয়েটির লাশ দাহ করে। মেয়েটির পরিবার অভিযোগ করে, এই লাশ দাহকালীন তারা পুলিশের দ্বারা গৃহবন্দী ছিলেন। জোরপূর্বক এই গোপনীয়ভাবে মেয়েটির লাশ দাহ করার ঘটনা গণধর্ষণের বিরুদ্ধে চলা বিক্ষোভকে উস্কে দেয়। এর ফলে বহু সাংবাদিক এ প্রসঙ্গে খবর সংগ্রহের জন্য হাথরস যান। সিদ্দিক কাপ্পান ছিলেন তাদের একজন।
কাপ্পান মালায়লাম ভাষার নিউজ পোর্টাল আজিমুখামের সাথে জড়িত। ৫ অক্টোবর উত্তর প্রদেশের পুলিশ হাথরসগামী একটি গাড়ি থেকে তাকে তুলে নেয়, তার সাথে তখন আরও ৩ জন ছিল ওই গাড়িতে।
সিদ্দিকি কাপ্পানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ
পুলিশ তার বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে অভিযোগ দায়ের করে। এই দীর্ঘ সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ছয়বার মামলার শুনানি মুলতবি করেছে। প্রতিবার শুনানির সময় নতুন নতুন ধারায় অভিযোগও আনা হয়েছে। দলিত তরুণীর ধর্ষণের খবর করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়া সাংবাদিক সিদ্দিকি কাপ্পানকে শুনতে হয়েছে তার পরিচয়পত্র মেয়াদোত্তীর্ণ, তিনি জাতপাত সংক্রান্ত উত্তেজনা উস্কে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং জঙ্গি মনোভাবাপন্ন সংগঠনের সদস্য।
পুলিশের মিথ্যাচার
প্রথমদিকে এই মামলার দায়িত্বে থাকা উত্তর প্রদেশের এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা শ্রিষ চন্দ্র গ্রেফতারের সময় সিদ্দিকি কাপ্পান যে একজন সাংবাদিক ছিলেন তা জানার কথা অস্বীকার করে বলেন, শুরুতে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। সিদ্দিকিও বলেননি এবং সঙ্গে তার কোনও আইডি কার্ড ছিল না। তা না হলে কেন আমরা তাকে থামিয়েছি যখন সব সাংবাদিক সেখানে গিয়েছেন?
তিনি জানান, পুলিশ একটি গাড়িতে কয়েকটি জিনিসের ওপর শোয়া অবস্থায় চার ব্যক্তিকে পায়। পরে তারা পিএফআই সংশ্লিষ্ট কিছু লেখা ও নথি গাড়ি থেকে উদ্ধার করে।
উল্লেখ্য, পিএফআই বা পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া একটি মুসলিম সংগঠন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সংগঠনটির সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে দাবি করে। তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যা ও সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সংগঠনটির দাবি, তারা ভারতে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কাজ করছে।
পুলিশের ভাষ্যমতে, সিদ্দিকির সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া তিনজনের দুজন পিএফআই-এর ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া’র সদস্য। সিদ্দিকি পিএফআই-এর অফিস সেক্রেটারি এবং সাংবাদিকতাকে ছদ্মবেশ হিসেবে কাজে লাগাতেন।
এদিকে উত্তরপ্রদেশ সরকারের অভিযোগ, সিদ্দিকি পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া (পিএফআই)-র সক্রিয় সদস্য এবং দফতর সচিব। তিনি সাংবাদিকতার নাম করে হাথরসে গিয়ে উত্তেজনা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সিদ্দিকির সাংবাদিক পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সরকার। তার জেরে ইউএপিএ-তে মামলা দায়ের করা হয়।
তবে সূত্র মতে, সিদ্দিকি ২০১৯ সালে নয়া দিল্লির কেইউডব্লিউজে-এর সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। গ্রেফতারের সময় তার সঙ্গে প্রেস কার্ড না থাকার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা খারিজ করেছে সংগঠনটি।
এছাড়া সিদ্দিকির আইনজীবী উইলস ম্যাথুস বলেন, তার মক্কেলের বিরুদ্ধে মামলাটি মিথ্যা তথ্যে ভরপুর। সিদ্দিকি যে পিএফআই-র অফিস সেক্রেটারি এই বিষয়ে পুলিশ আদালতে কোনও প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, তার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই। গ্রেফতারের পর এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। কেন অতিরিক্ত এফআইআরে তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হলো?
হতাশায় পর্যদুস্ত কাপ্পান সিদ্দিকির পরিবার
কেরলের মল্লপুরমের বাড়ি থেকে তিন সন্তানকে নিয়ে গত পাঁচ মাস ধরে একাই জীবনযুদ্ধ লড়ছেন কাপ্পান সিদ্দিকির স্ত্রী রেহানাথ সিদ্দিকি। সিদ্দিকির বৃদ্ধা মাকে প্রতিনিয়ত মিথ্যা আশ্বাস দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত।
সিদ্দিকির গ্রেফতার প্রসঙ্গে রেহানাথ বলেন, ‘‘ওকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। পাঁচ মাস ধরে আইনি লড়াইয়ে সাহায্য করছেন কেরলের সাংবাদিকদের ইউনিয়ন।’
আরও বলেন, ‘আর কত দিন ওকে জেলে আটকে থাকতে হবে? অন্তত ওর মৃতপ্রায় মায়ের কাছে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হোক!’
কাপ্পানের স্ত্রী রেহানাথ সিদ্দিকি এবং তিন সন্তান। সূত্র: আল জাজিরা।
কাপ্পান সিদ্দিকির দাদা হানজা সিদ্দিকি জানান, কাপ্পানের সঙ্গে সেপ্টেম্বর মাসে শেষ বার ফোনে কথা হয়েছিল মায়ের। তার পর থেকে বহুবার নব্বই বছর বয়সী মা ছেলের খোঁজ করেছেন। জবাব পাননি। তাকে সত্যি কথাটা জানানোর সাহস পায়নি পরিবার। বর্তমানে তিনি এতটাই অসুস্থ যে, আর কথা বলার অবস্থাতেও নেই।
তিনি আরও বললেন, ৫ ফেব্রুয়ারি ভিডিও কলে মায়ের সঙ্গে দেখা করানো হয়েছিল কাপ্পানের। মা শুধু কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কোনও কথা বলতে পারেননি।
হানজা সিদ্দিকি বলেন, ‘আমার ভাই সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বলেছে প্রয়োজনে হলে ও পলিগ্রাফ টেস্ট করাতেও রাজি। ও সত্যি বলেছে না মিথ্যা, প্রমাণ হয়ে যাবে। ভাই বলেছে, দরকার হলে ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে লেনদেনের যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখা হোক। কিন্তু সে সব কিছুই হচ্ছে না। শুনানির তারিখ অকারণে দীর্ঘ করা হচ্ছে। ফের মার্চ মাসের ৯ তারিখ শুনানি।’
তার আরও অভিযোগ, ঘটনার পর থেকে কাপ্পানের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি ওদের। ভাই ফোনে ওর স্ত্রীকে জানিয়েছে, পুলিশ হেফাজতে ওকে মারধর করা হয়েছিল। কিন্তু তার কোনও প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। তিন সন্তানকে নিয়ে রেহানাথ কীভাবে আছে, আমরাই জানি। সকলে ওর পাশে আছি আমরা।
অসুস্থ মায়ের সঙ্গে দেখা করতে শর্তসাপেক্ষে জামিন
প্রায় সাড়ে ৫ মাস পর শর্তসাপেক্ষে অসুস্থ মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য সোমবার কাপ্পান সিদ্দিকির ৫ দিনের জামিন মঞ্জুর করেছে সুপ্রিম কোর্ট।।শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে, সিদ্দিকি সংবাদমাধ্যমে কিছু বলতে পারবেন না। নেটমাধ্যমেও মন্তব্য করতে পারবেন না। মায়ের স্বাস্থ্যের প্রশ্নে আত্মীয় পরিজন এবং চিকিৎসক ছাড়া তিনি আরও কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। উত্তরপ্রদেশ পুলিশকে তার কেরল সফর এবং ফিরে আসা নিশ্চিত করতে হবে বলেও নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। অন্তর্বর্তী জামিনের পঞ্চম দিন শেষ হলে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হাতে নিজেকে সমর্পণ করার জন্য কাপ্পানকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
কেরলের মল্লপুরমের বাসিন্দা কাপ্পানের মা দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। অসুস্থ মায়ের সঙ্গে কাপ্পান যাতে দেখা করতে পারেন সেই জন্যই জামিন দিয়েছে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি এসএ বোবডের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। গত মাসে কাপ্পানকে মায়ের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগাযোগের অনুমতি দেয় আদালত। তবে সূত্র মতে, তার মা হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে কাপ্পানের আইনজীবী কপিল সিব্বল আদালতকে বলেন, ‘আবেদন খারিজ হলে কিছু মনে করব না। কিন্তু আমাদের কথা শুনুন। কাপ্পানের মা হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় আছেন। তাই আমরা আবেদন করেছি, তার মৃত্যুর আগে এক বার অন্তত তাকে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হোক।’
এর পরই ভিডিও কনফারেন্সের অনুমতি দেওয়া হয় কাপ্পানকে। যদিও তাতে শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ হয়নি। অবশ্য এই অন্তর্বর্তীকালীন জামিনও আটকানোর চেষ্টা করেছিল সরকার। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা কাপ্পানের জামিনের বিরোধিতা করেন। কিন্তু বিচারপতি জানিয়ে দেন, ‘তার মায়ের মৃত্যু হতে পারে এমন আশঙ্কা করেই মানবিক কারণে জামিন দিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের আমলে ভারতের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের হেনস্থ হতে হয়েছে বিনা কারণে। দেশটি ২০২০ সালে প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্সে ১৪২ তম হয়েছিল। যেখানে ২০১৫ তে ছিল ১৩৬ তম এবং ২০১৬ তে ১৩৩ তম। ভারতের মতো বৃহৎ লোকতন্ত্রের দেশে জাত – ধর্ম – রাজনৈনিক প্রভাবের কারণবশত সংবাদমাধ্যমের গলা টিপে ধরার এই প্রবণতা দেশটির নিম্নবর্ণের মানুষের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করছে। আর সামাজিক এবং রাজনৈতিক এই বিভেদনীতিরই বলি হতে হলো সাংবাদিক সিদ্দিকি কাপ্পানকে।
এসডব্লিউ/১৪০৩
আপনার মতামত জানানঃ