পথে-ঘাটে ঘরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। চলতে ফিরতে তাদের প্রায়ই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। নারীদের পাশাপাশি নিরাপদ নয় মেয়েশিশুরাও। শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতনের মাত্রা যেন দিনদিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। ঘরে, ঘরের বাইরে ও নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নিরাপদ নয় তারা। এমনকি নিরাপদ নয় ভার্চ্যুয়াল জগতেও। অনলাইনে মেয়েশিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন দ্বারাই। অনলাইনে ৩৬ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু বন্ধুদের দ্বারা এবং ২৭ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু পরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও আত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এছাড়া ১৮ শতাংশ অপরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ঢাকা ও সাতক্ষীরায় ১৭৮ শিশুর ওপর বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার(২৫ ফেব্রুয়ারি) ‘অনলাইনে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও আইনি পর্যালোচনা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
ভার্চুয়াল সভায় উপস্থাপিত জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের মধ্যে ৮২ জন ছেলে ও ৯৬ জন মেয়েশিশু ছিল। ৮ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু অনলাইনে যৌন শোষণ, হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সাইবার বুলিং ও যৌন আবেদনমূলক কনটেন্টের মুখোমুখি হয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ শিশু। ২৩ শতাংশ মেয়েশিশু যৌন কনটেন্টের মুখোমুখি হয়েছে। ৪৬ শতাংশ অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব পেয়েছে।
জরিপে অংশ নেয়া শিশুদের ৬৪ শতাংশের বেশির নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। বাকিরা মা-বাবার ফোন ব্যবহার করে। ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৬৩ শতাংশ ছেলেশিশু মেয়েশিশুদের তুলনায় নিজেদের বেডরুমে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়।
মতবিনিময় সভায় আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট ও ৯টি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য তুলে ধরা হয়। সভায় আসক জানায়, ২০১১ সালে অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ৩৫ জন শিশু। ২০২০ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ জনে। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৯৯ শিশু অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
সভায় বলা হয়, করোনাকালে শিশুদের দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতে হচ্ছে অনলাইন স্কুলে। হোমওয়ার্ক, খেলাধুলা বা বিনোদনের ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনলাইনভিত্তিক। ফলে শিশুরা আরও বেশি হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বা ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, শিশু-কিশোরদের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে সরিয়ে নয়; বরং প্যারেন্টাইল গাইডলাইন ব্যবহার করে তাদের ডিজিটাল অপরাধ থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
মন্ত্রী বলেন, দেশে ২০০৮ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল প্রায় ৮ লাখ। এখন ১১ কোটিতে পৌঁছেছে। সরকার ৩০ হাজার পর্নো সাইট বন্ধ করেছে। ইন্টারনেটে পর্নো সাইট অনুসন্ধানে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে ছিল। এখন বাংলাদেশের অবস্থান ১০০এর নিচে রয়েছে। নতুন প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব পালনের জন্য সবাইকে ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে, দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, শিশুদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বোধশক্তি গড়ে ওঠেনি, তাই ইন্টারনেট ব্যবহারের এই চ্যালেঞ্জ শিশুদের নয়। এই চ্যালেঞ্জ বাবা–মা, শিক্ষক ও সরকারের। নতুন প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব পালনের জন্য সবাইকে ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে, দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে। সন্তানদের চেয়ে অভিভাবকেরা প্রযুক্তি দক্ষতায় পিছিয়ে রয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য আরোমা দত্ত বলেন, কভিড ১৯ শিশু-কিশোরদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই অনলাইন মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ বিশেষ করে আইনের প্রয়োগ, ডাটাবেজ সংরক্ষণ, সমন্বয় সাধন জরুরি।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসপাব) প্রেসিডেন্ট এম এ হাকিম বলেন, বিশ্বজুড়ে এখন ৫০ থেকে ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে পর্নোগ্রাফির। ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে তা অবৈধ মাদক ব্যবসার বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধি ও সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এখন বিটিআরসি সাইবার সচেতনতা ইউনিট ও সাইবার ৯৯৯ হেল্পলাইন চালু করতে পারে।
তিনি জানান, সরকারের নির্দেশে ইসপাব বিনামূল্যে প্যারেন্টাল নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখলেও এখন পর্যন্ত কোনো অভিভাবক তাদের কাছে সহায়তা চাইতে আসেননি।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রামের প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা অ্যান্ডরু ম্যাকগ্রেগর বলেন, প্রযুক্তির বিকাশে ইন্টারনেট বড় আবিস্কার হলেও কিছু মানুষ এর অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের যৌন নির্যাতন করছে, প্রতারণা করছে। ঘটনা প্রতিকারে আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।
সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় আইন কমিশনের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ (শিশু অধিকার আইনবিষয়ক ফোকাল পারসন) ফারজানা হোসাইন, ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের পরিচালক (কর্মসূচি) নাসিমা আক্তার জলি, লালমাটিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ও ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি ইউনিটের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ নবকুমার দত্ত।
সম্প্রতি সাইবার স্পেসে শুধু নারী ভিকটিমদের সহায়তার জন্য ‘police cyber support for women’ নামের একটি সেবা উদ্বোধন করেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। সেখানে জানানো হয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারী ৬৮ শতাংশ নারী সাইবার অপরাধের শিকার হন। এই ভিকটিমদের বয়স ১৬ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। এখন হয়রানির বিচার পেতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করার সুযোগ তৈরি হওয়াতে অপরাধের পরিমাণ কমে আসবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
এখন পর্যন্ত সাইবার অ্যাক্টে ৬ হাজার ৯৯টি মামলা হয়েছে। এই অপরাধগুলো নিয়ে ডিএমপি, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই, কাজ করছে। আইজিপি জানান, ‘আপনারা যারা সাইবার জগতে প্রবেশ করেছেন, সাইবার জগতের ঝুঁকি বিষয়ে সচেতন হয়েই ব্যবহার করবেন। তারপরও যদি কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা তৈরি হয় সে বিষয়ে আমরা কাজ করবো।’ এক্ষেত্রে ভিকটিমের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে বলেও জানানো হয়।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ইউনিটটি টেকনিক্যাল সহযোগিতা ও করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিতে কাজ করবে উল্লেখ করে কর্মকর্তারা বলছেন, কেবল যৌন হয়রানি নয়, সাইবার জগতের সব ধরনের হয়রানির শিকার নারীদের আমরা সেবা দেবো।
এদিকে হাইকোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক যে কোনও নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফি, যেকোনও ধরনের অশালীন চিত্র দেখানো, অশালীন উক্তি করাসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আইনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে। সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা সময়ে নিজের যৌন লালসা পূরণ করার জন্য ধর্ষকামীরা বেছে নিচ্ছেন সবচেয়ে সহজ শিকার শিশুদের৷ বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার কারণে এই বিষয়ে একটা ট্যাবু তৈরি হয়েই আছে৷ ফলে পরিবারের কারও কাছ থেকে নির্যাতনের শিকার হলে, পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে সেটা শেয়ার করা শিশুদের পক্ষেও সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না৷
তারা বলেন, প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা যায় দিনের পর দিন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসলেও, কোনোক্ষেত্রে ‘পরিবারের সম্ভ্রম’, কখনও ‘ভবিষ্যত হয়রানির’ কথা চিন্তা করে অনেকদিন পর্যন্ত বিষয়গুলো ধাপাচাপা দিয়ে রাখা হয়৷ অথচ, হওয়ার কথা ছিল ঠিক উলটোটা৷ মুখ লুকিয়ে থাকার কথা ধর্ষক ও নির্যাতনকারীদের৷ সামাজিকভাবে হেয় এবং আইনের দৃষ্টিতে সাজা হওয়ার কথা ধর্ষকদের৷ সুতরাং এই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এই ট্যাবুটা ভাঙতে না পারলে এই সমস্যা বাড়বে বই কমবে না৷
বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেও এজন্য দায়ী করেন কেউ কেউ৷ নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা, পুলিশের তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়াকেও অনেকক্ষেত্রে অনেক ভিকটিম ‘দ্বিতীয় ধর্ষণ’ বলে উল্লেখ করেছেন৷ নির্যাতন এবং মামলার হারের তুলনায় রায় ও শাস্তি কার্যকরের হার খুবই কম বলে জানান তারা৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৩
আপনার মতামত জানানঃ