স্বামীরা অফিস আদালতে কাজ করে প্রতিমাসের শেষে মোটা অংকের বেতন নেন। কিন্তু স্ত্রীরাও যে ঘরে থেকে ডিউটি টাইমের তোয়াক্কা না করেই দিনরাত কাজ করে যান, এবিষয়ে তাদের কোনো বেতন দেওয়ার কথা ভাবেন না স্বামীরা। তারা মনে করেন, ঘরের কাজ করার জন্য স্ত্রীদের বেতন দেওয়ার প্রয়োজন কী! আসলে ঘর-গেরস্থালির কাজকে কাজ বলে ধরা হয় না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই নিয়মের বিরুদ্ধে এবার দাঁড়ালেন চীনা আদালত। ঘোষণা করলেন, ঘরের কাজের জন্য স্ত্রীদের বেতন দিতে হবে স্বামীদের। চীনের বেইজিংয়ের একটি আদালত এমনই রায় দিয়েছে। আজ বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
চলতি বছরই চীনে নতুন দেওয়ানি আইন কার্যকর হয়। সেই আইনের আলোকে রায় দিলেন আদালত। বেইজিংয়ের আদালতের এই রায়কে ঐতিহাসিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। আদালতের এই রায়ের ফলে ওই নারী তার পাঁচ বছরের বৈবাহিক জীবনে গৃহকর্মের জন্য ৫০ হাজার ইউয়ান পাবেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা সাড়ে ছয় লাখ টাকার বেশি।
নতুন আইন অনুযায়ী, বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন, যদি তিনি বৈবাহিক জীবনে তার জীবনসঙ্গীর তুলনায় ঘরের কাজ ও দায়িত্ব বেশি পালন করেন।
আদালতের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিয়ে করেন চেন এবং ওয়াং। পাঁচ বছর সংসার করার পর ২০২০ সালে স্ত্রী ওয়াংকে তালাক দেন স্বামী চেন। তবে তালাকের বিষয়টি মানতে পারছিলেন না স্ত্রী। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তিনি।
স্ত্রীর দাবি, পাঁচ বছরের সংসার জীবনে ঘরের কোনো কাজে তাকে সাহায্য করেননি স্বামী চেন। এমনকি বাচ্চার দেখাশোনার কাজেও স্ত্রীর হাতে হাত মেলাননি তিনি। সন্তান লালন-পালনসহ সংসারের সব কাজ তিনি একাই করেছেন। আর তাই ক্ষতিপূরণ পাওয়া তার অধিকার।
স্ত্রী ওয়াংয়ের এই যুক্তি মেনে নেয় বেইজিংয়ের ফাংশান জেলার আদালত। ওয়াং বৈবাহিক জীবনে ঘরের যেসব কাজ করেছেন, তার জন্য তাকে এককালীন ৫০ হাজার ইউয়ান দিতে চেনকে নির্দেশ দেন আদালত। এ ছাড়া বিচ্ছেদর পর ওয়াংয়ের খোরপোষ বাবদ তাকে মাসে দুই হাজার ইউয়ান করে দেওয়ার জন্য চেনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালত বলেছেন, বিবাহবিচ্ছেদের পর সাধারণত দুজনের (দম্পতি) যৌথ পরিমাপযোগ্য সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়। কিন্তু গৃহকর্ম অপরিমাপ্য সম্পত্তি, আর তার মূল্য রয়েছে।
তবে আদালতের রায় নিয়ে চীনের সাইবার জগতে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। অনেক বলছেন, পাঁচ বছরের পারিশ্রমিক হিসেবে ওই নারীকে যে পরিমাণ অর্থ দেওয়ার নির্দেশেনা দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। পাঁচ বছরের গৃহকর্মের জন্য ৫০ হাজার ইউয়ান খুবই কম মজুরি।
চীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইবোতে একজনের মন্তব্য, তিনি হতবাক। একজন পূর্ণকালীন গৃহিণীর ঘরের কাজের মূল্যকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। বেইজিংয়ে একজন আয়াকে এক বছরের জন্য নিয়োগ দিলে ৫০ হাজার ইউয়ানের বেশি খরচ হয়।
কেই কেউ বলছেন, সংসারে পুরুষদের আরও বেশি ঘরের কাজ করা উচিত।
‘অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ’ নামে একটি সংস্থা বিভিন্ন এলকায় নারীদের এই কাজের মূল্যায়ন নিয়ে কাজ করছে৷ ‘অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ’ ২০১৩ সাল থেকে লালমনিরহাট ও গাইবান্ধার ১০টি ইউনিয়নে একটি গবেষণা শুরু করে৷ গবেষণার বিষয় ছিল, ‘প্যাটার্ন অফ টাইম ইউজ অফ অ্যাডাল্ট ম্যান অ্যান্ড ওম্যান’৷ ২০১৬ সালে প্রকাশিত ৬০০ পরিবারের ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যায়, একজন নারী প্রতিদিন গড়ে আট ঘণ্টা ঘরের সেবামূলক কাজে ব্যয় করেন৷ সেবামূলক কাজকেই আসলে ঘর-গৃহস্থালির কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এই গবেষণায়৷
গবেষকরা জানিয়েছিলেন, ‘‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, নারীরা ঘরের এই সেবামূলক কাজে প্রতিদিন আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেও পুরুষ করে মাত্র এক ঘণ্টা ২০ মিনিট৷ আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, নারীর এই সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই৷”
তারা বলেন, ‘‘পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না থাকায় নারী প্রচুর কাজ করেও অবহেলিত৷ অন্যদিকে আমাদের মোট জাতীয় আয়েও এর কোনো প্রতিফলন নেই৷ এমনকি নারীদেরও বড় একটা অংশ মনে করেন যে, এটা তাদের স্বাভাবিক কাজ৷ তাই এটা তো তাদের করতেই হবে৷ এটার আবার মূল্যায়ন কী? তারা অনেকেই তাদের এই সময় এবং পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজের মূল্যায়ন নিয়ে সচেতন না৷”
নারীর এই ধরনের সেবামূলক ঘর-গৃহস্থালির কাজের একটি আর্থিক মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এর যৌথ গবেষণায়৷ গবেষণাটি পচিালিত হয় ২০১৪ সালে৷ এই গবেষণায় ৬৪টি জেলায় নমুনা জরিপ চালিয়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারীরা ঘরের যেসব সেবামূলক কাজ করে থাকেন, তার পরিমাণ জন প্রতি গড়ে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা৷ একই কাজ পুরুষ করে মাত্র দু’ঘণ্টা৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর ঘরের কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন খুবই জরুরি৷ আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই৷ তারা (স্ত্রীরা) পরিবারের জন্য যে কাজ করেন তা পরিমাপ ও হিসাব করতে একটি প্রক্রিয়া বা কৌশল বের করতে হবে। এতে সামাজিকভাবে নারীর পরিচয়ের ব্যাপারটি জোরদার হবে। তারা বলেন, নারী ঘরে যে কাজ করেন তাও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, তবে তা হিসেবের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। শিশুদের পরিচর্যা কেন্দ্রে পাঠাতে খরচ হয়, আবার পরিবারের বাইরের কেউ ঘরের রান্না বা অন্য কাজ করলে তাকেও র্অথ দিতে হয়। আর স্ত্রীদের কাজের উৎকর্ষতার সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলতে পারে না। তারা বলেন, স্বামীর বেতনের একটি অংশ যদি স্ত্রীর নামে দেওয়া হয়, তাহলে তা সম্ভবত শিশুর ভালো খাবার, শিক্ষা বা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেই ব্যয় করা হবে।
তারা বলেন, গৃহস্থালীর কাজ অর্থনৈতিক কমকাণ্ড, এটা স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) সত্যিকার প্রতিফলন এতে পাওয়া যাবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা দেশে মোট প্রকৃত বেকারের সংখ্যাও বের করতে পারব। তারা বলেন, দুনিয়াব্যাপী মজুরিভিত্তিক কাজে প্রাধান্য পুরুষের, সেবামূলক কাজে নারীদের। আবার নারীর অমূল্যায়িত কাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এ জন্য জাতীয় আয়ের হিসাবে নারীর এ ধরনের কাজ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এতে কিছু সমস্যা থাকলেও অসম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০২
আপনার মতামত জানানঃ