চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল ২০২২ পুরস্কার পেলেন ফরাসি নাগরিক অ্যানি এরনোক্স। স্টকহোমে সুইডিশ একাডেমি স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দুপুর ১টায় ২০২২ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করে।
অ্যানি তার লেখায় ‘সাহস এবং তীব্র নির্লিপ্ততার’ সমাবেশ ঘটিয়েছেন এবং এর সাহায্যে ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড় থেকে জীবনবোধের বিচ্ছিন্নতা, সংযম এবং অন্যান্য বিষয় উন্মোচন করার জন্যই তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি।
এ ছাড়া, অ্যানি তার লেখায় ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লিঙ্গ, ভাষা এবং শ্রেণি ইত্যাদির ভিত্তিতে গভীর ভেদ চিহ্নিত করার মাধ্যমে জীবনকে দেখেছেন।
এবারের নোবেল কমিটির প্রধান অধ্যাপক কার্ল-হেনরিক হেলডিন এই ঔপন্যাসিক সম্পর্কে বলেন, তার কাজ ‘প্রশংসনীয় এবং কালজয়ী’।
‘‘তিনি সাহসের সঙ্গে এবং অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে সামাজিক অভিজ্ঞতার দ্বন্দ্বগুলো তুলে ধরেছেন এবং আপনাকে নিজের সমানে দাঁড় করাতে লজ্জা, অপমান, ঈর্ষা ও অক্ষমতাকে বর্ণনা করেছেন।”
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান জানিয়েছে, নরম্যান্ডির একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া অ্যানিকে তার আত্মজীবনীমূলক ঘরানার ‘আ উইমেনস স্টোরি’, ‘আ মেনস প্লেস’ ও ‘সিম্পল প্যাশন’ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি এনে দেয়।
অ্যানি এরনোক্স ৩০টিরও বেশি সাহিত্যকর্ম লিখেছেন।
জন্ম
অ্যানি এরনোক্সের জন্ম হয়েছে ১৯৪০ সালের ১ সেপ্টেম্বর। তার সাহিত্য মূলত আত্মজীবনীমূলক ও সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৭তম নারী হিসেবে এই পুরস্কার জিতেছেন তিনি।
অ্যানি বলেছেন, লেখালেখি একটি রাজনৈতিক কাজ, যা সামাজিক বৈষম্যের প্রতি আমাদের চোখ খুলে দেয়। এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘ছুরি’ হিসেবে নিজের ভাষা ব্যবহার করেন, যা তার কল্পনার আবরণ ছিঁড়ে ফেলতে সাহায্য করে।
‘মুক্তচিন্তার লেখক’
লেখালেখি শুরু করার আগে অ্যানি একজন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের সেইন-মেরিটাইমে তার জন্ম। তার লেখা উপন্যাসগুলোকে সমসাময়িক সময়ের ‘ক্ল্যাসিক’ বলে বিবেচনা করা হয়।
অধ্যাপক হেলডিন বলেন, ‘‘অ্যানি এরনোক্স মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। যা তার লেখালেখিতে স্পষ্ট। তার কাজ আপসহীন এবং তিনি অত্যন্ত সরল ভাষায় লেখেন। খুবই পরিষ্কার ও স্পষ্ট ভাষায়।”
অ্যানি এরনোক্স মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। যা তার লেখালেখিতে স্পষ্ট। তার কাজ আপসহীন এবং তিনি অত্যন্ত সরল ভাষায় লেখেন। খুবই পরিষ্কার ও স্পষ্ট ভাষায়।
অ্যানি এরনোক্স সম্পর্কে সেন্ট অ্যান্ড্রুস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়বসাইটে লেখা হয়, ‘‘চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজের কাজের মাধ্যমে তিনি প্রধানত যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছেন তা হল: শরীর এবং যৌনতা, অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, সামাজিক বৈষম্য ও শিক্ষার মাধ্যমে শ্রেণী পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা, সময় ও স্মৃতি। বিস্তৃত প্রশ্নের মাধ্যমে জীবনের এই অভিজ্ঞতাগুলি কীভাবে লিখতে হয় তাও তিনি তুলে ধরেছেন।”
‘একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী লেখক’
ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এরনোক্সকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তার কণ্ঠকে “নারীর স্বাধীনতা এবং ভুলে যাওয়া” বলে অভিহিত করেছেন।
জ্যাক টেস্টার্ড, অ্যানির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশক, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওর নিউজ আওয়ারকে বলেছেন, তিনি একজন “অসাধারণ এবং অনন্য” লেখক।
তিনি বলেন, “তিনি একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী লেখক। আমি বলব, একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক শ্রেণীর লেখক। এই দুটি থিমই আমি মনে করি তার কাজের মধ্যে খুব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।”
অ্যানির মার্কিন প্রকাশক ড্যান সাইমন এক বিবৃতিতে বলেছেন, “তিনি একজন নারী হিসাবে নিজের জন্য দাঁড়িয়েছেন। এমন একজন, যিনি ফরাসি শ্রমিক শ্রেণী থেকে এসেছেন, নতজানু হয়ে দশকের পর দশক ধরে”।
ডাঃ রুথ ক্রুকশ্যাঙ্ক, যিনি রয়্যাল হলওয়ে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ফরাসি কথাসাহিত্যে বিশেষজ্ঞ, বলেছেন: “যখন একজন নারী সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার জিতেন তখন এটি দুর্দান্ত এক ব্যাপার। ১৯০১ সাল থেকে ১৩ জন মৃত এবং দুই জীবিত শ্বেতাঙ্গ ফরাসি পুরুষ নোবেল বিজয়ী হয়েছেন।
যখন একজন নারী সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার জিতেন তখন এটি দুর্দান্ত এক ব্যাপার। ১৯০১ সাল থেকে ১৩ জন মৃত এবং দুই জীবিত শ্বেতাঙ্গ ফরাসি পুরুষ নোবেল বিজয়ী হয়েছেন।
“তিনি জীবনের অভিজ্ঞতার স্মৃতিগুলো অন্বেষণ করেছেন। অসাধারণ এবং প্রাসঙ্গিক। একটি ব্যাকস্ট্রিট গর্ভপাত; রাশিয়ায় প্রেমিকের সাথে বা ৩০ বছরের যুবকের সাথে ব্যর্থ সম্পর্ক; তার পিতামাতার মৃত্যু; স্তন ক্যান্সার।”
সাহিত্য কমিটির চেয়ারম্যান অ্যান্ডার্স ওলসন বলেন, “অ্যানি নরম্যান্ডিতে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে তার প্রাথমিক জীবনের পরিবেশ ছিল “দরিদ্র কিন্তু উচ্চাভিলাষী”।”
অ্যানির ওয়েবসাইট অনুসারে, তার বাবা-মা একটি ক্যাফে এবং মুদির দোকান চালাতেন। যখন তিনি মধ্যবিত্ত মেয়েদের মুখোমুখি হন, তখন তিনি প্রথমবার তার “শ্রমজীবী বাবা-মা এবং পরিবেশের লজ্জা” অনুভব করেন। যা পরবর্তীতে তার উপন্যাসে আসে।
তার অফিসিয়াল জীবনী বলে, তার কাজের মূল বিষয়বস্তু ছিল “শরীর এবং যৌনতা; অন্তরঙ্গ সম্পর্ক; সামাজিক বৈষম্য এবং শিক্ষার মাধ্যমে শ্রেণী পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা; সময় এবং স্মৃতি; এবং এই জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো কীভাবে লিখতে হয় তার ব্যাপক প্রশ্ন”।
“ক্লিনড আউট” ছিল ১৯৬৪ সালে তার অবৈধ গর্ভপাতের একটি কাল্পনিক বিবরণ, যা তার পরিবারের কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন।
তিনি ২৫ বছর পরে “হ্যাপেনিং” বইটির জন্য সেই ট্রমাটি আবার নিয়ে আসেন। যেখানে তিনি সেই দিনগুলো থেকে তার স্মৃতি এবং জার্নালের মাধ্যমে ফিরে আসেন। এটা নিয়ে একটি মুভিও বানানো হয়েছিল। যা গত বছরের ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পুরস্কার জিতেছিল।
ওলসন বলেন, “অ্যানি স্পষ্টভাবে লেখার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তার কাজ আপোষহীন এবং সরল ভাষায় লেখা, ঘষামাজা করার মতো একদম পরিষ্কার।”
আশির দশকের গোড়ার দিকে অ্যানির ডিভোর্স হয়। ২০০০ সালে তিনি লেখালেখিতে নিয়োজিত করার জন্য শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন।
অ্যানির আরেকটি বই “দ্য ইয়ার্স” ২০০৮ সালে ফ্রান্সে “প্রিক্স রেনাউট” এবং ২০১৬ সালে ইতালিতে “প্রিমিও স্ট্রেগা” জিতেছিল। এর এক বছর পরে তিনি সারা জীবনের কাজের জন্য “মার্গুরাইট ইয়োসেনার” পুরস্কার জিতেছিলেন।
২০১৯ সালে “দ্য ইয়ার্স” ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছিল। বিচারকরা এটিকে একটি “জেনার-বেন্ডিং মাস্টারপিস” বলে অভিহিত করেছেন।
বুকার সেই সময়ে বলেছিলেন যে “আত্মজীবনীকে একটি নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে, একইসাথে বিষয়গত এবং নৈর্ব্যক্তিক, ব্যক্তিগত এবং যৌথ”।
দ্য নিউ ইয়র্কার ২০২০ সালে লিখেছিল, তার ২০টিরও বেশি বইয়ে “তিনি একটি একক কাজে নিবেদিত হয়েছেন: তার নিজের জীবনের খনন”।
১৯০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১৪ বার পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। পেয়েছেন সব মিলিয়ে ১১৯ জন। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে যথাক্রমে ১৯১৪,১৯১৮ এবং ১৯৪০,১৯৪১, ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এর বাইরেও ১৯৩৫ সালেও সাহিত্যে কাউকে নোবেল দেওয়া হয়নি।
নোবেল পুরস্কারের অন্যান্য শাখায় পুরস্কার একই সঙ্গে একাধিক ব্যক্তির মধ্যে বিভাজিত হতে দেখা গেলেও সাহিত্যের বেলায় বিষয়টি বেশ দুর্লভ। এখন পর্যন্ত মাত্র চারবার পুরস্কারটি দুজন করে বিজয়ীর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল জেতেন রুডিয়ার্ড কিপলিং। ১৯০৭ সালে যখন তিনি তার ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ বইয়ের জন্য নোবেল পুরস্কার জেতেন তখন তার বয়স মাত্র ৪১ বছর।
সাহিত্যে নারী বিজয়ীদের সংখ্যাও বেশ কম। ১৯০৪ সালে সেলমা লাগেরলফ প্রথম নারী হিসেবে নোবেল জেতেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে গ্রাজিয়া দালেদা, সিগ্রিড আন্ডেস্ট, পার্ল বাক, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, নেলি সাঁচ, নাদিন গার্ডিমার, টনি মরিসন, উইস্লাওয়া সিম্বরস্কা, ডোরিস লেসিং, হের্টা মুলার, এলফ্রিডে এলিনেক, এলিস মুনরো, স্ভেৎলানা এলেক্সিয়েভিচ, ওলগা তেগারচুক এবং ২০২০ সালে লুইস গ্লুক সর্বশেষ নারী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল জেতেন।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত পদার্থ, চিকিৎসা এবং রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল জয়ীরা হলেন—অ্যালাইন আসপেক্ট, জন এফ ক্লসার এবং আন্তন জেলিঙ্গার। চিকিৎসায় নোবেল জিতেছেন সুইডিশ জিনতত্ত্ববিদ সান্তে পাবো এবং রসায়নে নোবেল জয়ী তিনজন হলেন—ক্যারোলিন আর. বের্তোজি, মর্টেন মেলডাল এবং কে. ব্যারি শার্পলেস।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/০০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ