মধ্যপ্রাচ্যের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। যদিও বিগত দুই বছর ধরে কর্মী রফতানি প্রায় বন্ধ রয়েছে দেশটিতে। এ অবস্থায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার খোলার বিষয়ে (১৬ ফেব্রুয়ারি) থেকে দুই দেশের মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। কয়টি রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় আবারও নতুন করে কর্মী পাঠাবে সেই সংখ্যা নির্ধারণে একমত হতে পারেনি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া। অনলাইনে দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক একদিনের হওয়ার কথা ছিল। তবে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যাগত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রথম দিন বৈঠক মুলতবি হয়। বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দ্বিতীয় দিনেও একই প্রশ্নে কোনও সুরাহা করতে পারেনি দুই দেশ। জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়ার বিষয়ে একমত হতে না পারায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার প্রক্রিয়া আরেক দফা অনিশ্চয়তায় পড়ল।
বৈঠক শেষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার কর্মী নেওয়ার সমঝোতার মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন তারা। আলোচনার মধ্যে অনেকটা একমত-দ্বিমত চলছিল। কয়েকটি ইস্যু ছিল, সেগুলো আমরা শেষ করতে পারিনি। কারণ, এই ইস্যুতে মালয়েশিয়ার নিজেদের অভ্যন্তরীণ আলোচনার বিষয় আছে। আমাদেরও অভ্যন্তরীণ আলোচনার দরকার আছে।
তিনি বলেন, সাধারণ কিছু ইস্যুতে আমরা একমত হয়েছি। যেমন, লিগালাইজেশন ফি কমানোর কথা। এখানে যে ২০ হাজার কর্মী আটকা পড়ে আছে তাদের ফেরত নেওয়ার কথাও আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, মালয়েশিয়া দুই দেশে ২৫টি করে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কথা প্রস্তাব করে। এতে বাংলাদেশের ২৫ এজেন্সির আওতায় ১০টি করে ২৫০ এজেন্সির নিয়োগের সুযোগ রাখার কথা বলা হয়। মালয়েশিয়ায় সেদেশের ২৫টি এজেন্সিই কাজ করার কথা বলা হয়। এ বিষয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হতে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে মালয়েশিয়ায় সেদেশের এজেন্সি সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে আবেদন তোলেন বাংলাদেশি কর্মকর্তা। মালয়েশিয়া তার নিজের দেশের সংখ্যা বাড়াবে কিনা এজন্য নিজেদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। শেষ মুহূর্তের এই আপত্তি অনিশ্চিত করে তোলে সম্ভাবনার শ্রমবাজারকে।
এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি নির্ধারণের প্রস্তাব ছিল। তবে শ্রমবাজারে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা কত হবে, তা নিয়ে দুই দেশ একমত হতে পারেনি।
এদিকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি পাঠানোর জন্য নতুন করে স্বল্পসংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট তৈরির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) সিন্ডিকেট নির্মূল ঐক্যজোট। সব বৈধ এজেন্সিকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়ে তারা বলছেন, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি প্রেরণকারী অন্য ১৩টি দেশ কোনো নির্দিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠায় না। সেখানে সব বৈধ এজেন্সিই কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সব বৈধ এজেন্সিকে সুযোগ না দিলে আগের মতো নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাবে শ্রমবাজারটি।
বায়রা সিন্ডিকেট নির্মূল ঐক্যজোটের দাবি, ২০১৭-১৮ সালে ১০টি এজেন্সির মাধ্যমে মাত্র ২ লাখ ৫৯ হাজার কর্মী পাঠানো হয়। অথচ ১৫ লাখ কর্মী পাঠানোর সুযোগ ছিল। এতে সব এজেন্সি ব্যবসা করার সুযোগ হারায়, আর দেশ হারায় বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠানোর সুযোগ। সিন্ডিকেটের কারণে দেশ ও অন্য এজেন্সিগুলোর এ ক্ষতি হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা চলমান থাকবে। যে আলোচনা হয়েছে সেটি দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে হয়েছে। এখানে অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলোর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। তবে আলোচনার মূল বিষয় ছিল কর্মী নিয়োগে এজেন্সিগুলোর পরিধি। আমরা চাই সর্বোচ্চ সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সি এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকুক। এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার কিছু প্রস্তাব আছে। তাদের প্রস্তাবের বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার প্রয়োজন আছে। মূল বিষয়টা আসলে এজেন্সিগুলোর অংশগ্রহণের পরিধি নিয়েই।’
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগের জন্য ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার তৎকালীন মানবসম্পদ মন্ত্রী ঢাকায় এমওইউ বা সমঝোতা স্মারকে সই করেন। পরে জি টু জি পদ্ধতিতে দুই লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যায়। কিন্তু শ্রমিক নিয়োগে অনিয়ম এবং অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করে মালয়েশিয়া সরকার।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত প্রায় দুই বছর ধরে কর্মী রফতানি প্রায় বন্ধ রয়েছে মালয়েশিয়ায়। ২০১৭ সালে দেশটিতে যান ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন কর্মী। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে যান প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার। তবে কর্মী রফতানির নামে দুদেশের মধ্যে গড়ে ওঠে একটি চক্র। বাংলাদেশী ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির গঠিত ওই চক্র হাতিয়ে নেয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশী কর্মী নেয়া বন্ধ হয়।
২০১৯ সালে দেশটিতে গেছেন মাত্র ৫৪৫ জন। পুনরায় কর্মী রফতানি শুরু করতে বিগত বছরে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠকেও কোনো ফল আসেনি। যদিও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে রয়েছে কর্মীর চাহিদা, যা প্রতিনিয়তই দখলে নিচ্ছে ভারত, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এমনকি চীনের কর্মীরাও।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠান শ্রমিক রপ্তানি করুক। এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার বেশ কিছু প্রস্তাব আছে। ওই প্রস্তাবের সঙ্গে আমাদের উচ্চপর্যায়ের আলোচনা প্রয়োজন আছে। দুই দেশের মধ্যে বৈঠকে সবগুলো সিদ্ধান্ত কর্মকর্তারা নিতে পারবেন না। মূল বিষয়টি আলোচনা হয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সির অংশগ্রহণের পরিধি নিয়ে। তাদের উচ্চপর্যায়ে বা রাজনৈতিকভাবে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলেও জানিয়েছে মালয়েশিয়া। তবে বাংলাদেশশের নিজেদের স্বার্থে দ্রুত এর সমাধান করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ