মীর মোনাজ হক, বার্লিন : আল–জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ তথ্যচিত্রে সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিস আহমেদ ও আনিস আহমেদ’কে পলাতক আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দুজনই খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে – ২০১৯ সালে তাঁদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে গেলেও এত দিন তা গোপন ছিল।
এখন আল–জাজিরায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ১৫ দিন পরে সরকার বলছেন তাদেরকে ২ বছর আগে ক্ষমা করা হয়েছে। এই সংক্রান্ত একটি DW এর লাইভ অনুষ্ঠানে বাংলা বিভাগের প্রধান জনাব খালেদ মহিউদ্দিন ৫ জন আইনজীবী ও একজন বিচারকের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছেন যে, কারাদন্ড প্রাপ্ত আসামীর তখনি ক্ষমা করা সম্ভব যদি দণ্ডপ্রাপ্তরা সশরীরে আদালতে উপস্থিত হয়ে নিজেরা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চান। হারিস আহমেদ ও আনিস আহমেদ নিজেরা পুরোটা সময় পলাতক ছিলেন, তাহলে কিভাবে তাদেরকে ক্ষমা করেছে সরকার? আজ আল জাজিরার প্রতিবেদনের ১৫ দিন পরে সেনাপ্রধানের সেই বহুল আলোচিত দুই সহোদর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের “সাজা মওকুফ করেছে সরকার” মর্মে খবর কেনো এসেছে? হারিছ দুটি এবং আনিস একটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাঁদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেটা এখন বলা হচ্ছে কেনো?
সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে তাদের ইংরেজী টক শো ‘কনফ্লিক্ট জোনে” আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে এই দুই পলাতক সহোদরের বাংলাদেশে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ নানা বিষয় উঠে আসে। কিন্তু সেখানেও উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেননি যে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো লিখছে “হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই। তাঁদের আরেক ভাই তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফও খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় কারামুক্ত হন তিনি। জোসেফের সাজা মাফ করার জন্য আবেদন করেছিলেন তাঁর মা রেনুজা বেগম। হারিছ ও আনিসের জন্য কে, কখন, কীভাবে আবেদন করেছেন – সে তথ্য এখনো পরিষ্কার হয়নি। জেনারেল আজিজ আহমেদের আরেক ছোট ভাই টিপু আহমেদ ১৯৯৯ সালে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছিলেন।
জেনারেল আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। এর এক মাস আগে ২০১৮ সালের ২৭ মে সাজা মওকুফের পর ছাড়া পান জোসেফ। আর ৯ মাস পর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের যাবজ্জীবন সাজা মাফ করা হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যে শর্ত মেনে নেয়, সেই শর্তে তার দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারে।”
প্রথম আলো আরো লিখছে- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, যেদিন মন্ত্রণালয় থেকে সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি হয়, সেদিনই ঢাকার পৃথক দুটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তার অনুলিপি পাঠানো হয়। এই দুটি বিচারিক আদালত আসামিদের সাজা দিয়েছিলেন। আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রজ্ঞাপন পাওয়ার পর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের নামে থাকা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বিনা তামিলে ফেরত পাঠানোর জন্য মোহাম্মদপুর ও কোতোয়ালি থানাকে আদেশ দেন আদালত।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ষড়যন্ত্রমূলক, পরিকল্পিত, সাজানো ও বানোয়াট মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের যাবজ্জীবন সাজা ও অর্থদণ্ড ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে মওকুফ করা হয়েছে।
এদিকে আইনমন্ত্রী বলছেন, “কারও সাজা মওকুফ করা হয়েছে কি না, তা আমি জানি না। এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।” আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় পলাতক কারও সাজা মওকুফ করা হলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি হবে। এটা আইনের স্পষ্ট বিধান।”
প্রথম আলো লিখছে, এই প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, আইনসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিবকে পাঠানো হয়। পাশাপাশি আসামি হারিছ আহমেদ, আনিস আহমেদ ও তাঁদের মা রেনুজা বেগমকেও প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। সরকারের এতগুলো দপ্তরে প্রায় দুই বছর আগে এই প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি গেলেও এত দিন তা গোপন ছিল কেনো?
হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল–৩–এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহবুবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নথিপত্র না দেখে কিছু বলা যাবে না।’ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল–৪–এর পিপি আবদুল কাদেরও একই কথা বলেন। এই দুই আদালত হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছিলেন।
এই সাজা মওকুফের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারও সাজা মওকুফ করা হয়েছে কি না, তা আমি জানি না। এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।’
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক কোনো ব্যক্তি কখনো কোনো ধরনের আইনি সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার ভোগ করতে পারে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় পলাতক কারও সাজা মওকুফ করা হলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি হবে। এটা আইনের স্পষ্ট বিধান। তিনি বলেন, যদি কেউ এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করে সাজা মওকুফের ব্যবস্থা করেন, তাহলে তাঁর বা তাঁদের বিরুদ্ধেও আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কারণ, পলাতক আসামির দণ্ড মওকুফ করার অর্থ ক্ষমতার বেআইনি ব্যবহার ও অপপ্রয়োগ।
“কোনো আইনগত অধিকার পলাতক আসামি পায় না। আইনগত অধিকার পেতে হলে তাকে সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করতে হয়।” বলেনছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
তাহলে এখন কেনো বলাহচ্ছে দুই দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর সাজা মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে? সূত্র: DW এবং প্রথম আলো
আপনার মতামত জানানঃ