প্রকল্প প্রণয়ন পরিকল্পনা রুই কাতলা হলেও বাস্তবে বাস্তবায়ন হয় চুনোপুঁটি। আর বাকি সমস্তই যায় প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের পকেটে। এ অভিযোগ খুব প্রচলিত। কেননা, এসব কাজগুলো আড়ালেই চলে। তবে এসব আড়াল ভেদ করে এলো প্রকল্প লুটপাটের এক ভয়াবহ চিত্র। অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সম্প্রতি একটি ফোনলাপ ফাঁস হয়। ফোনালাপকে কেন্দ্র করে বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় চলছে ব্যাপক তোলপাড়। বলা হচ্ছে, ফাঁস হওয়া ওই ফোনালাপটি উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার ও সাময়িক বরখাস্ত সংরক্ষিত নারী সদস্য (৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড) দিপালী হালদারের।
সরকারি কাজে দূর্নীতি-অনিয়ম করে ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে টাকা ভাগাভাগির ওই ফোনালাপের রেকর্ড গত বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৪টা ৩২ মিনিটে “মোঃ জুনায়েদ সিদ্দিক” নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা হয়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার (ভাইরাল) পর সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। ১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের এই টেলি সংলাপের অডিও ক্লিপটি এখন ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে; যার একপ্রান্তে ছিলেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেবী রানী হাওলাদার এবং অন্যপ্রান্তে একই ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য দিপালী হালদার।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জল্লা ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য দীপালি হালদার একাধিক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন—উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণতি বিশ্বাসের কাছে অভিযোগ করেন ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার। ইউএনও লিখিত অভিযোগ স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরে পাঠালে দীপালিকে হালদারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে দীপালি চেয়ারম্যান বেবীকে মুঠোফোনে কল করেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির টাকা ভাগাভাগির বিষয়টি প্রকাশ পায়।
ওই ফোনালাপে শোনা যায়, ইউপি সদস্য দীপালি হালদার চেয়ারম্যানকে বলছেন, ‘আপনি ইউএনওর কাছে আমার নামে প্রস্তাব দিয়েছেন কেন? আপনি যে টাকা চাইছেন, আমি আপনাকে ৭০ হাজার টাকা দিছি। আগেরবার কর্মসূচির ৫০ হাজার টাকা দিছি। আমি কি আপনারে কম টাকা দিছি? তারপরেও কেন অভিযোগ দিলেন?’ উত্তরে চেয়ারম্যান বেবী বলেন, ‘৭০ হাজার দেও, আর ৯০ হাজার টাকা দেও, সেটা কোনো বিষয় না। তোমার হিসাবে কত আসে, সেটাই দিতে হবে। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা লিখে দিছেন, চেয়ারম্যানের প্রজেক্টে ১ লাখ ১০ হাজার, আর তোমার প্রজেক্টে ৯০ হাজার।’ তখন দীপালি বলেন, ‘আমি একবার ৭০ হাজার টাকা, পরে ৫০ হাজার টাকা দিছি। ওই কাজে আমি মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিছি।’ চেয়ারম্যান ক্ষুব্ধ হয়ে ওই সদস্যকে বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান হইয়া ৭০ হাজার টাকা দিতে পারছি, আমার স্বামী (নিহত চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালাদার নান্টু) এত টাকা দেনা রেখে গেছেন। আমি সেগুলো দিতে পারছি, আর তোমরা মেম্বার হইয়া দিতে পারবা না!’
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (৪০ দিন) এই প্রকল্পে উজিরপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে তিন হাজার ৫৭ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২ কোটি ৫৯ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৩ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মোট ৬৬টি প্রকল্পের জন্য সরকারের ওই অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে জল্লা ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৪১ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বরাদ্দের বেশিরভাগ টাকা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আত্মসাৎ করেছেন। জল্লা ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্পের সভাপতি এবং ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নিজেদের পছন্দের লোককে শ্রমিক দেখিয়ে তাদের নামে ব্যাংক হিসাব খোলেন। পরে প্রকল্পের ভুয়া শ্রমিকের হিসাব নম্বর থেকে টাকা উত্তোলন করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করছেন।
এ বিষয়ে সাময়িক বরখাস্ত সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য দিপালী হালদার এক দৈনিককে বলেন, ‘ফোনালাপের কণ্ঠ আমার। তবে এটি কীভাবে ফাঁস হলো, সেটা আমি জানি না।’ তিনি দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যানের আনা অভিযোগ সত্য নয়।
এসব বিষয়ে জল্লা ইউপির চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার দাবি করেন, ইউপির অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মহিলা সদস্য দীপালি হালদারকে ব্যবহার করে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অয়ন সাহা বলেন, ‘আমার বরাত দিয়ে অন্য কেউ ঘুষ চাইলে তার দায় আমার না। তবে এ ধরনের ঘটনার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জল্লা ইউপির চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারের কাছে ঘুষের টাকা দাবির অভিযোগ অস্বীকার করে উজিরপুরের ইউএনও প্রণতি বিশ্বাস বলেন, ‘চেয়ারম্যান মিথ্যা ও বানোয়াট কথা বলেছেন। তাঁর সঙ্গে ওই প্রকল্প নিয়ে কোনো কথা হয়নি। তা ছাড়া কোনো কাজেই অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না। প্রকাশিত ফোনালাপের অডিও রেকর্ডটি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ফোনালাপটি প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ফোনালাপে যাদের কণ্ঠ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তারাই কথাই বলেছেন প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। যারাই সম্পৃক্ত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের সমস্ত প্রকল্পেই এমন ঘুণপোকাদের অস্তিত্ব রয়েছে, কর্তৃপক্ষ দেখতে চাইলে অবশ্যই দেখতে পাবে। কিন্তু জানা সত্বেও প্রকল্প বিষয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। অনিয়ম দুর্নীতি সমাজে এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রুপান্তরিত হওয়ায় এসব নিয়ে আলোচনারও তেমন একটা আগ্রহ দেখানো হয় না। কেননা, দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া এবং এসব রোধে সরকারের সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ না করায় বিষয়টাতে এখন অনেকটাই ঢিলেমি চলছে। সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে প্রকল্পে আরো তদন্তের আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ